নাবী মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ (সা.) এর অন্তিম সময়ের বিবরণ

মুহাম্মাদ (সা.) এর ইন্তেকালের সময়ের ঘটনাবলী

নবী মুহাম্মাদ (সা.) এর মৃত্যু

বিদায় হজ্জ্ব থেকে ফেরার পর নবী করীম সা. এর মৃত্যুকালীন ব্যাধির সূচনা হলো। ধীরে ধীরে তা বাড়তে লাগল।

বিভিন্ন অসিয়ত উচ্চারণ করে তিনি উম্মতকে বিদায় জানাচ্ছিলেন।

জ্বর যখন তীব্র থেকে তীব্রতর হতে লাগল, পরকালের দিকে যাত্রা নিশ্চিত জানতে ও বুঝতে পারলেন, তখন লোকদের থেকে বিদায় নেয়ার ইচ্ছা করলেন। সাদা কাপড়ে মাথা পেঁচিয়ে নিলেন। 

ফাযল বিন আব্বাসকে নির্দেশ দিলেন সবাইকে মসজিদে সমবেত করতে। তিনি গিয়ে সকলকে মসজিদে জমায়েত করলেন। দু'জনের কাঁধে ভর করে নবী করীম সা. মসজিদের মিম্বরে এসে বসলেন। আল্লাহর যথাযোগ্য প্ৰশংসা করে বলতে লাগলেন,

“হে লোকসকল, আমার উপর তোমাদের কিছু পাওনা আছে বলে মনে হচ্ছে। এই স্থানে তোমরা আর কোনোদিন আমাকে দেখতে পাবে না। 

ভালো করে শুন! আমি যদি কারো পিঠে বেত্রাঘাত করে থাকি, তবে এই আমার পিঠ, সে যেন প্রতিশোধ নিয়ে নেয়। কারো থেকে যদি কোনো সম্পদ নিয়ে থাকি, তবে এই হলো আমার সম্পদ, সে যেন সমপরিমাণ নিয়ে নেয়। যদি কারো মানহানি করে থাকি, সে যেন এর বদলা নিয়ে নেয়। 

কেউ যেন শত্রুতার ভয়ে অন্তরে কিছু লুকিয়ে না রাখে। শত্রুতা আমার অভ্যাস নয়, আমার স্বভাবও নয়। বরং যে আমার কাছে কিছু পাবে এবং সে নিজের প্রাপ্য নিয়ে নেবে বা সমাধা করে ফেলবে, তাকেই আমি বরং অধিক আপন ভাববো। 

যেন আল্লাহর সাথে সাক্ষাতকালে আমার উপর বিন্দুমাত্র কোনো পরাধিকার না থাকে..!” (তাবারানী-৭১৮)



অতঃপর নবীজী মিম্বর থেকে নেমে নিজের ঘরে চলে গেলেন ।

নবী করীম সা. এর মৃত্যুকালীন রোগ দিনদিন জ্বর তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছিল। খুব কষ্ট করে মসজিদে মানুষদের নিয়ে নামায পড়তেন। জুমুআর দিন সাথীদের নিয়ে মাগরিব আদায় করে ঘরে প্রবেশ করলেন। জ্বর আরো তীব্র হলো। সাথীগণ বিছানা করে তাঁকে শুইয়ে দিলেন। বিছানায় থাকা অবস্থায়ই মৃত্যুজনিত রোগ ধীরে ধীরে তাঁর উপর ভর করতে লাগল ।


মানুষ ইশা'র নামাযের জন্য নবীজীর ইমামতির অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে ছিল। এদিকে অসুস্থতাও বাড়ছিল। 

বিছানা থেকে উঠার চেষ্টা করছিলেন, পারছিলেন না। বিলম্ব হওয়ায় কিছু মানুষ “নামায, নামায” বলে ঘোষণাও দিলেন। 

নবীজী তাদের কণ্ঠ শুনে কাছের লোকদের দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কি নামায পড়ে ফেলেছে? তারা বলল, না হে আল্লাহর রাসূল! সকলেই আপনার অপেক্ষায়! 


নবীজী মসজিদের দিকে তাকিয়ে উঠতে চাইলেও শরীরের অত্যধিক তাপমাত্রা তাঁকে সে সুযোগ দেয়নি। নবীজী বললেন, বড় পাত্র দিয়ে পানি ঢালো! সবাই তাঁর জন্য পানির ব্যবস্থা করে শরীরে পানি ঢালতে লাগলেন ।

কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর কিছুটা উদ্যমতা অনুভব করলে “যথেষ্ট হয়েছে” ইঙ্গিত দিলেন। পানি সরিয়ে নেয়া হলো। দুই হাতে ভর করে উঠতে চেষ্টা করলেন, এমনসময় অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কি নামায পড়ে ফেলেছে? তারা বলল, না হে আল্লাহর রাসূল! সবাই আপনার অপেক্ষায়! 


বললেন, বড় পাত্র দিয়ে পানি ঢালো! অতঃপর সবাই তাঁর জন্য পানির ব্যবস্থা করে সারা গায়ে পানি ঢালতে লাগলেন। কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর আবারো কিছুটা উদ্যমতা অনুভব করলে দুই হাতের উপর ভর করে উঠতে যেয়ে আবার অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। 

কিছুক্ষণ পর জ্ঞান ফিরলে প্রথমেই আবার জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কি নামায পড়ে ফেলেছে? বলল, না হে আল্লাহর রাসূল! সবাই আপনার অপেক্ষায়! বললেন, বড় পাত্র দিয়ে পানি ঢালো!


আবারো পানির ব্যবস্থা করে সারা গায়ে অধিক পরিমাণে ঠাণ্ডা পানি ঢালা হলো। কিছুক্ষণ পানি ঢালার পর “যথেষ্ট হয়েছে” ইঙ্গিত করলেন। আবারো দুই হাতে ভর করে উঠতে যেয়ে অজ্ঞান হয়ে পড়লেন। 


পরিবারের সদস্যগণ তাঁর দিকে মায়াভরে তাকিয়ে ছিলেন। অন্তরগুলো তাদের ধুকধুক করছিল। চোখে অশ্রু টলমল করছিল। সবাই মসজিদে নামাযের জন্য তাঁর অপেক্ষায়। তাকে ইমাম হিসেবে দেখতে, তাঁর সঙ্গে তাকবীর বলে, তাঁর সঙ্গে রুকু সেজদা করে নামায আদায় করবে.. এ আশায় সকলেই অধীর আগ্রহে বসে ছিলেন। 

এদিকে নবীজী অচেতন। কিছুক্ষণ পর হুঁশ ফিরে এলে প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, সবাই কি নামায পড়ে ফেলেছে? সবাই বলল, না হে আল্লাহর রাসূল! তারা আপনার অপেক্ষায়!


হ্যাঁ.. সেই পবিত্র দেহ, যা আল্লাহর দ্বীনকে সাহায্য করেছে, পালনকর্তার জন্য সদা প্রাণ বাজি রেখে যুদ্ধ করেছে। সেই পবিত্র দেহ, যা স্রষ্টার এবাদতে বহু রাত বিনিদ্র কাটিয়েছে, জীবনে সকল কঠিন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছে। সেই পবিত্র দেহ, আল্লাহর ভয়ে যার দু'চোখ অঝোর ধারায় অশ্রু বর্ষণ করেছে। আল্লাহর রাস্তায় শাস্তি ভোগ করেছে, ক্ষুধার্ত থেকেছে, যুদ্ধ করেছে..।


নবীজী নিজের শারীরিক অবস্থা বুঝতে পেরে সাথীদের বললেন, “আবু বকরকে বল সকলকে নিয়ে নামায আদায় করে নিতে”। 


বেলাল রা. নামাযের ইকামাত বললেন। আবু বকর রা. নবীজীর মেহরাবে দাঁড়িয়ে নামাযের ইমামতি করলেন। প্রচণ্ড কান্নার দরুন সাহাবীগণ তার কেরাত ভালো করে বুঝতে পারলেন না। এভাবেই এশার নামায শেষ হলো।

পরদিন ফজরের নামায আদায়ের জন্য সবাই জমায়েত হলেন। আবু বকর রা. ইমামতি করলেন। নবীজীর মৃত্যুশয্যায় আবু বকর রা. এভাবে দিন-কয়েক নামাযের ইমামতি করেছিলেন।


জামাতে নামায

সোমবার-দিন জুহর এবং আসরের সময় নবীজী কিছুটা সুস্থতা অনুভব করলে আব্বাস ও আলী রা. কে ডেকে উভয়ের কাঁধে ভর করে ধীরে ধীরে ঘর থেকে বের হলেন, একটু অগ্রসর হয়ে পর্দা উঠিয়ে দেখলেন যে, জামাত দাঁড়ানো, সকলেই নামাযে মগ্ন ।

দেখলেন, সাথীরা সারিবদ্ধভাবে দাঁড়িয়ে আছে। উজ্জ্বল চেহারা আর পবিত্র দেহ।


এই লোকদের নিয়েই তো তিনি কত নামায আদায় করেছেন! তাদেরকে সাথে নিয়ে জিহাদ করেছেন! দিনরাত তাদের সাথে উঠা-বসা করেছেন! কত রাত তাদের নিয়ে দীর্ঘ নফল পড়েছেন! কতদিন তাদের নিয়ে রোযা পালন করেছেন! কতই না ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছে তারা তাঁর সাথে। নিষ্ঠার সাথে দোয়া করেছে আল্লাহর কাছে। দ্বীনকে বিজয়ী করতে কত সময় তারা পরিজনকে দূরে রেখেছে। বন্ধু-বান্ধব এবং দেশকে পরিত্যাগ করেছে।

তাদের মধ্যে আবার অনেকেই শহীদ হয়ে গেছে আবার অনেকেই শাহাদাতের অপেক্ষায়..। বাস্তবেই, একটুও বদলায়নি তারা। আজ তিনিই তাদের ছেড়ে চলে যাচ্ছেন পরকালের উদ্দেশ্যে, যেখানকার সুখ-শান্তির কথা শুনিয়েছেন তাদের সারা জীবনভর। তাদেরকে নামাযে দেখে খুবই আপ্লুত হলেন, আনন্দে মুচকি হাসলেন। মনে হচ্ছিল তাঁর চেহারা যেন এক টুকরো চাঁদ। অতঃপর পর্দা নামিয়ে বিছানায় ফিরে এলেন। আসমান হতে মৃত্যুর ফেরেশতাগণ অবতরণ করলেন সর্ব পবিত্র ও শ্রেষ্ঠ আত্মাকে নিয়ে যেতে।


নবীজীর উপর মৃত্যু-যন্ত্রণা

ধীরে ধীরে মৃত্যু-যন্ত্রণা শুরু হতে লাগল। উম্মুল মুমিনীন আয়েশা রা. বলেন,

“মৃত্যুর সময় আমি নবীজীকে দেখেছি, তিনি পাশে রাখা পানি- ভর্তি পাত্রে হাত ভিজিয়ে চেহারা মুছতে মুছতে বলছেন, আল্লাহ ছাড়া কোনো মা'বুদ নেই! অবশ্যই মৃত্যুর যন্ত্রণা আছে! 

ফাতেমা রা. পাশে বসে কেঁদে কেঁদে বলছিলেন, আব্বুর উপর কী বিপদ..! নবীজী ফাতেমার দিকে তাকিয়ে বললেন, আজকের পর থেকে তোমার আব্বুর কোনো বিপদ থাকবে না। 

আমি তাঁর চেহারা মুছে দিচ্ছিলাম আর সুস্থতার দোয়া করছিলাম। তিনি বললেন, না! বরং আমি সর্বোন্নত সাথী আল্লাহকে চাই; জিবরীল, মিকাঈল এবং ইসরাফীলের সাথে..!


অতঃপর যখন নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসছিল, যন্ত্রণা তীব্রতর হচ্ছিল, তখন সর্বশেষ কথাগুলো তিনি উচ্চারণ করছিলেন। 

সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ কথাগুলো বলছিলেন, শিরক থেকে উম্মতকে

সতর্ক করছিলেনঃ

لَعَنَ اللَّهُ اليَهُودَ وَالنَّصَارَى اتَّخَذُوا قُبُورَ أَنْبِيَائِهِمْ مَسَاجِدَ.

“ইহুদী খৃস্টানদের উপর আল্লাহর অভিশাপ, নবীদের কবরগুলোকে তারা মসজিদ বানিয়েছে"

اشتدَّ غضبُ اللَّهِ على قومٍ اتَّخذوا قبورَ أنبيائِهم مساجدَ

“ঐ জাতির উপর আল্লাহর ক্রোধ অধিক হয়েছে, যারা তাদের নবীদের কবরগুলোকে মসজিদ বানিয়েছে”


নবীজীর সর্বশেষ উচ্চারিত ছিল।

الصَّلاةَ وما ملَكَت أيمانُكم، الصَّلاةَ وما مَلَكت أيمانُكم

“নামায, নামায.. এবং তোমাদের আয়ত্তাধীন কৃতদাস..!” এরপর নবীজী ইন্তেকাল করলেন (আমার পিতা-মাতা এবং আমার আত্মা তার জন্য উৎসর্গ হোক) সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।


হ্যাঁ.. সর্বশেষ নবী, শ্রেষ্ঠ রাসূল, হেদায়েত-প্রাপ্তদের ইমাম এবং রাব্বুল আলামীনের প্রিয়পাত্র দুনিয়া থেকে বিদায় হয়ে গেছেন। 

কেউ তার প্রতি কোনোরূপ জুলুমের অপবাদ দেয়নি, কথার মাধ্যমে কাউকে আঘাত দেয়ার অভিযোগ করেনি, হারাম পথে উপার্জনের সাক্ষ্য দেয়নি, কখনো কেউ তাকে পরনিন্দা বা অপরাধ করতে দেখেনি। বরং তিনি তো ছিলেন আল্লাহর দিকে মানুষকে আহ্বানকারী, আল্লাহর কাছে ক্ষমা প্রার্থনাকারী, নামায ও এক আল্লাহর দিকে এবাদতের আদেশকারী এবং শিরক ও মূর্তিপূজা থেকে বারণকারী মহান ব্যক্তিত্ব।


পালনকর্তা তাঁর গুণ বর্ণনায় সত্যই বলেছেন,

لَقَدْ جَاءَكُمْ رَسُولٌ مِنْ أَنفُسِكُمْ عَزِيزٌ عَلَيْهِ مَا عَنِتُمْ حَرِيصٌ عَلَيْكُم بِالْمُؤْمِنِينَ رَءُوفٌ رَّحِيمٌ ) التوبة: ١٢٨

“তোমাদের কাছে এসেছে তোমাদের মধ্য থেকেই একজন রাসূল। তোমাদের দুঃখ-কষ্ট তার পক্ষে দুঃসহ। তিনি তোমাদের মঙ্গলকামী, মুমিনদের প্রতি স্নেহশীল, দয়াময়।” (সূরা তাওবা-১২৮)


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url