মহররামুল হারাম সম্পর্কে একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক-নির্দেশনা
মুসলমানদের নিকট এ মাসটি মর্যাদাপূর্ণ ও ফযিলতপূর্ণ মাস। মহররাম অর্থই হল সম্মানী; পবিত্র। সাধারণত ধারণা করা হয় যে, মহররামের ফযিলতের কারণ হল রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের দৌহিত্র হযরত হাসান রাযির এ মাসে শাহাদাতবরণ। ধারণাটি ভুল। কারণ এ মাসের ফযিলত ইসলামের অনেক পূর্ব থেকেই রয়েছে ।
রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম মদিনা তাশরিফ নিয়ে গেলে সেখানে দেখতে পেলেন, ইয়াহুদিরা এই দিনে রোযা রাখছে। তিনি তাদের এই দিনে রোযা রাখার কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তারা বলল, এটি একটি উত্তম দিন । এই দিনে আল্লাহ তাআলা বনি ইসরাইলকে তাদের দুশমন ফেরআউন থেকে মুক্তি দিয়েছেন। এজন্য হযরত মুসা আলাইহিস্সালাম এই দিনে রোযা রেখেছেন । এ-কথা শুনে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, হযরত মুসা আলাইহিস্সালামের সাদৃশ্য অবলম্বন করার ক্ষেত্রে তোমাদের থেকে আমরা অধিক হকদার। এরপর তিনি নিজেও রোযা রেখেছেন এবং সাহাবিদেরও রোযা রাখার নির্দেশ দিয়েছেন ।
সহিহ মুসলিম শরিফে হযরত আবু হুরায়রা রাযি. হতে বর্ণিত রয়েছে, রমযানের পর শ্রেষ্ঠ রোযা হল মহররমের রোযা এবং ফরয নামাযের পর শ্রেষ্ঠ নামায হল তাহাজ্জুদের নামায ।
তিনি এ-কথাও ইরশাদ করেছেন যে, মহররাম মাসে আমরাও রোযা রাখি এবং ইয়াহুদিরাও রাখে । এতে তাদের সঙ্গে আমাদের কিছুটা সাদৃশ্য হয়ে যায় । তাই আমি যদি আগামী বছর বেঁচে থাকি তা হলে শুধু আশুরার রোযা রাখব না; বরং তার সঙ্গে আরেকটি রোযা মিলিয়ে রাখব। ৯-ই মহররাম বা ১১-ই মহররামের রোযাও রাখব, যেন ইয়াহুদিদের সঙ্গে আমাদের সাদৃশ্য না থাকে ।
তাই সাহাবায়ে কিরাম আশুরার রোযার সঙ্গে তার আগের দিন বা পরের দিন রোযা রাখার প্রতি গুরুত্ব দিয়েছেন এবং এটাকে মুস্তাহাব সাব্যস্ত করেছেন । আর শুধু আশুরার দিনের রোযা রাখাকে রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ- উক্তির আলোকে মাকরুহ তানজিহি ও অনুত্তম সাব্যস্ত করেছেন ।
ইমাম বায়হাকি রহ. রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের এ হাদিসটি নকল করেছেন যে, যে-ব্যক্তি আশুরার দিন তার পরিবার-পরিজনের ওপর অকৃপণ হাতে ব্যয় করবে আল্লাহ তাআলা পুরো বছর তার রিজিকের মধ্যে সচ্ছলতা দান করবেন।
কতক লোক এই মাসে, বিশেষ করে আশুরার দিন মাতম এবং শোক প্রকাশ করে থাকে । এটা গোনাহর কাজ। ইসলাম আমাদের ধৈর্য এবং দৃঢ়তা শেখায় । জোরে জোরে রোনাজারি করা, বুকে আঘাত করা, নিজেকে ক্ষত-বিক্ষত করা, কাপড় ফাড়া – ইসলামি শিক্ষার সঙ্গে এগুলোর কোনও ধরনের সম্পর্ক নেই । ইসলামের নির্দেশ হল, কারও মৃত্যুর পর তিন দিনের অধিক শোক-তাপ প্রকাশ করা যাবে না ।
শুধুমাত্র মহিলারা তাদের স্বামীর মৃত্যুতে চার মাস দশ দিন শোক করবে। স্বামী ব্যতীত অন্য কারও জন্য চাই বাপ বা ভাই হোক কিংবা সন্তান হোক—তিন দিনের পর শোক করা যাবে না ।
কতক লোক হযরত হুসাইন রাযির শোক পালন করে। তারা মহররাম মাসে ভালো পোশাক পরিধান করে না; স্ত্রীর নিকট যায় না; চৌকি উল্টে রেখে দেয়; ইত্যাদি ইত্যাদি । অথচ হযরত হুসাইন রাযির শহিদ হয়েছেন প্রায় চৌদ্দ শত বছর আগে । এ-সবই অজ্ঞতা-প্রসূত কাজ । আল্লাহ তাআলা আমাদের সবাইকে হিদায়াতের ওপর রাখুন!
যখন তিনি শহিদ হয়েছেন শোক তখন ছিল। সারাজীবন শোক করা কারও জন্যই হালাল নয় । আর শোক প্রকাশের জন্য অনুষ্ঠান করা চাই হযরত হুসাইন রাযির জন্য হোক বা অন্য কারও জন্য হোক- মোটেই জায়েয নয় । কারণ শরিয়তে সবর করার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এর উল্টো দুঃখ-চিন্তা সৃষ্টি করাটাই পাপ । অনুষ্ঠান করে হযরত হুসাইন রাযি.র শাহাদতের বর্ণনা করা রাফেযিদের সাদৃশ্য হওয়ার কারণেও হারাম।”
হযরত মাওলানা মুহাম্মাদ শফি' রহ. বলেন-
আমাদের পুরো পরিবারই তো শহিদদের। একমাত্র হযরত আবু বকর রাযি. কে বাদ দিয়ে আমাদের বড়-বড় সবাই তো শহিদ। ওই সময় থেকে নিয়ে আজ পর্যন্ত আমাদের সকল বুযুর্গদের থেকে যদি শুধু শহিদদেরই আলোচনা করা হয় তা হলে ৩৬৫ থেকে অনেক বেশি পাওয়া যাবে।
সত্তুর জন শহিদ তো আছেন উহুদের যুদ্ধে; বদরের যুদ্ধে বারো জনের মত । এরপর রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সামনে-পিছনে কত যুদ্ধ হয়েছে। কতজন শহিদ হয়েছেন। হযরত উসমান রাযি. হযরত আলি রাযি. হযরত হুসাইন রাযি. কার কার জন্য মাতম করবে?
বাস্তবতা তো এটা যে, যদি প্রতি ঘণ্টায়ও একজন শহিদের আলোচনা করা হয় তা হলে পুরো বছরেও শহিদদের নাম শেষ করা যাবে না। ইসলামের জন্য যেসব শহিদ রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের ওপর জান কুরবান দিয়েছেন, তাঁদের জন্য মাতম করা কি গোনাহ হবে? এটা তো রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের উম্মতের জন্য গৌরবের বিষয় যে, যাঁরা শহিদ হয়েছেন, তাঁরা উঁচু মর্যাদা অর্জন করে সফলকাম হয়েছেন। এটা খুশির বিষয় । আল্লাহর রাস্তায় জান দিয়ে অনন্ত জীবন লাভ করেছেন। এটা তো সাহসীদের এবং বাহাদুরদের রীতি এবং স্বভাব । তাঁরা জীবনের দাবি আদায় করেছেন। এরপর কেমনসব ক্বারি, হাফেজ, আলেম, খলিফাদের শাহাদাতের পেয়ালা নসিব হয়েছে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম যা করেছেন; সাহাবায়ে কিরাম যা করেছেন, সেটাই পালন কর; সেটাই দীন।
কবরের প্রলেপ দেয়া বা তা পরিষ্কার করা জায়েয। তবে এর জন্য মহররাম মাসকে নির্ধারিত করে নেওয়া জায়েয নয়। যখনই সুযোগ পাওয়া যাবে পরিষ্কার করানো যাবে। কবর যিয়ারত করা সওয়াবের কাজ। কারণ সেগুলো দেখে পরকালের কথা স্মরণ হয়। কিন্তু এর জন্য লোকেরা দশ-ই মহররামকে নির্ধারণ করে নেয়, পুরো বছরে এর আগে-পরে কখনও ভুলেও কবরস্তানে যায় না এটা ঠিক নয় ।
-
কেউ-কেউ আশুরার দিন কবরের ওপর সবুজ ছড়ি রেখে দেয় এবং ধারণা করে, এর ফলে আযাব দূর হয়ে যাবে। এ-কাজটি আবশ্যকীয় করে নেওয়ার মধ্যে অনেকগুলো মন্দ দিক আছে। যেমন অনাবশ্যকীয় বিষয়কে আবশ্যকীয় মনে . করা হয় । আবার কেউ কেউ ধারণা করে যে, এতে আযাব দূর হয়ে যাবেই । এ- সব ঠিক নয় ।