খুশু কি? সালাতে খুশুর গুরুত্ব -শায়খ মুহাম্মাদ সালেহ আল মুনাজ্জিদ

খুশু কি   সালাতে খুশুর গুরুত্ব

সালাত বা নামাযে খুশু বা একাগ্রতা কি এবং কেন?

সমস্ত প্রশংসা সেই মহান আল্লাহর যিনি এই মহাবিশ্বের প্রভু; যিনি পবিত্র কোরআনে ঘোষণা

করেনঃ

وَقُومُوا لِلَّهِ قٰنِتِينَ

আর আল্লাহর সামনে দাঁড়াও একান্ত আদবের সাথে।" (সূরা আল বাকারা, আয়াত- ২৩৮)

আল্লাহ রাব্বুল আলামীন আরও বলেনঃ

وَاسْتَعِينُوا بِالصَّبْرِ وَالصَّلٰوةِ ۚ وَإِنَّهَا لَكَبِيرَةٌ إِلَّا عَلَى الْخٰشِعِينَ

ধৈর্যের সাথে সাহায্য প্রার্থনা কর নামাযের মাধ্যমে। অবশ্য তা যথেষ্ট কঠিন, কিন্তু সে সমস্ত বিনয়ী লোকদের পক্ষেই তা সম্ভব যারা কথা খেয়াল রাখে যে, তাদেরকে সম্মুখীন হতে হবে স্বীয় পরওয়ারদেগারের এবং ফিরে যেতে হবে তাঁরই দিকে।” (সূরা আল বাকারা, আয়াত -৪৫)

দরুদ সালাম আল্লাহর প্রিয় বার্তাবাহক মহানবী হযরত মুহাম্মাদ মুস্তফা (সাঃ) এর উপর যিনি সমস্ত মুত্তাকিনদের সর্দার এবং বিনয়ীদের প্রধান। শান্তি বর্ষিত হোক তার পরিবারবর্গ এবং সাহাবা আজমাঈনদের উপর।

ইসলামের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যবহারিক স্তম্ভ হল নামায এবং খুশ' হল শারিয়াহ কর্তৃক স্বীকৃত একটি আবশ্যকিতা

আল্লাহর শত্রু ইবলিস যখন আদম (আঃ) কে পথভ্রষ্ট এবং প্রলুব্ধ করার শপথ নেয় তখন সে (ইবলিস) বলেছিল-

*এরপর তাদের কাছে আসব তাদের সামনের দিক থেকে, পেছন দিক থেকে, ডান দিক থেকে এবং বাম দিক থেকে। * (৭৪১৭)

শয়তানের অন্যতম প্রধান ষড়যন্ত্র হলো যে কোন প্রকারে মানুষকে নামায থেকে ফিরিয়ে রাখা এবং নামাযের সময় তাদেরকে বিভ্রান্ত করা যাতে তারা ইবাদতের মূল আনন্দ এবং পুরস্কার থেকে বঞ্চিত হয়।

আমাদের নামাযের সাথে যখন খুশু সরাসরি সম্পর্কযুক্ত হয় তখন শয়তানের প্রথম কাজই হয় নামাযের খুশু' থেকে ভুলিয়ে ভালিয়ে সরিয়ে দেওয়া এবং শেষ কাজ হয় নামায থেকে বিরত রাখা।

বলা হয় যে এমন নামাযী লোকও থাকবে যার মাঝে। ভালত্বের লেশ নেই এবং মসজিদে ঢুকে দেখা যাবে সেখানে কারোও মাঝে খুশু' নেই। (আল মাদারিজ, ইবনুল কাইয়্যেম, /৫২১)

সুতরাং নামাযে মানুষের নিজের অবস্থান সম্পর্কে জানা, শয়তানের ওয়াসওয়াসার ষড়যন্ত্রের ব্যাপারে সতর্ক হওয়া এবং যে জন্য খুশুনষ্ট হয়ে যায় সে বিষয়ে সুস্পষ্টভাবে একটি আলোচনা অতীব প্রয়োজন।

 

আল্লাহ সুবহানাহু তায়ালা বলেনঃ

قَدْ أَفْلَحَ الْمُؤْمِنُونَ

الَّذِينَ هُمْ فِى صَلَاتِهِمْ خٰشِعُونَ

মুমিনগণ সফলকাম হয়ে গেছে, যারা নিজেদের নামাযে বিনয়-নম্র।” (২৩ঃ -)

অর্থাৎ তারা আল্লাহকে ভয় করে এবং নামাযে শিষ্টতা বজায় রাখে। খুশু অর্থই হল স্থির, প্রশান্তু, চুপচাপ, গাম্ভিরর্যতা, বিনীত এবং নম্র।

একজন লোকের খুশু আছে এর অর্থ হলো সে আল্লাহকে ভয় করে এবং অন্তরে এটা অনুভব করে যে আল্লাহকে সে দেখছে।

খুশু অর্থ হলো আত্মা বা হৃদয়কে আল্লাহর সামনে অত্যন্ত বিনীত, নম্র এবং অনুগতভাবে দাড় করানো। (আল মাদারিজ, /৫২০)

মুজাহিদ () বলেন, মাথানীচু করা, গভীর শ্রদ্ধায় অবনত বা আজ্ঞাবাহী হওয়া, দৃষ্টি নিবন্ধ করা এবং আল্লাহর ভয়ে বিনীত হওয়া- সবই এখানে খুশু' এবং আদবের অংশ যার উদ্দেশ্য আল্লাহর ইবাদত বা উপাসনা এবং তাকে মহিমাম্বিত করা। (তাজীম কদর আস্ সালাহ, /১৮৮)

খুশুর স্থান হল আত্মা বা হৃদয় এবং এর ক্রিয়া প্রকাশ পায় দেহের মাধ্যমে। আত্মা হলো শরীরের এমন একটি অংশ যাকে অন্যান্য অঙ্গ প্রত্যঙ্গ গুলো অনুসরণ করে

আত্মা যদি দূষিত হয় আর শয়তান যদি সুকৌশলে সেখানে প্রবেশ করে তবে দেহের বিভিন্ন অংশের ইবাদতও দূষিত হবে।

আত্মা বা হৃদয় হলো একজন রাজা এবং দেহের বিভিন্ন অংশগুলো হলো তার সৈন্য সামন্ত যারা রাজা যা আদেশ করে তাই করে এবং যেখানে যেতে বলে সেখানেই যায় রাজা হলি সিংহাসনচ্যুত হয় তবে সৈন্যরা বিভ্রান্ত হয় এবং বিভিন্ন দিকে পালিয়ে যায়। আর ঠিক এমনটাই হয় যদি আত্মাও যথাযথ ভাবে ইবাদত করতে ব্যর্থ হয়।

খুশু' জাহির করা একটি বিকৃত কাজ। প্রকৃত খুশু' চিহ্নগুলোর মধ্যে  হুজায়ফা (রাঃ) বলতেন, “খুশুর কপটতা থেকে সাবধান!” তাঁকে বলা হল, “খুশু কপটতা কি?” তিনি বললেন, “যখন দেহ খুশু' প্রদর্শন করে কিন্তু হৃদয়ে এর কোন স্থান থাকে না।

ফুযাইল ইবনে আয়াজ বলেন, “একজন মানুষের হৃদয়ে যতটুকু খুশু' আছে তার চেয়ে বেশী জাহির করা খুবই অপছন্দনীয় একটা কাজ। তিনি এক লোককে কাধ এবং শরীরে খুশু' প্রদর্শন করাতে দেখে বললেন, “দ্যাখো, দ্যাখো, লোকটার খুত' খানে।" এবং নিজের বুক নির্দেশ করে বললেন, “এই লোকটির এখানে কোন খুশু' নেই। এরপর কাধ নির্দেশ করে আবার বললেন।লোকটির খুশুএই কাঁধে।” (আল মাদারিজ, /৫২১)

প্রকৃত ঈমানের খুশু' এবং লোক দেখানো খুশু‘র সুন্দর তফাৎ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে ইবনুল কাইয়্যেম বলেছেনঃপ্রকৃত খুশু' তখনই অনুভূত হয় যখন হৃদয় মন আল্লাহর মহত্ব, মর্যাদা বা গৌরবের প্রতি সর্তক বিনয়ী হয় এবং সেই সাথে লজ্জা, ভয় এবং শ্রদ্ধামিশ্রিত সম্মানবোধে পরিপূর্ণতা লাভ করে

মনে হয় তার হৃদয়খানা ভেঙ্গে গেছে আর এই ভগ্ন, আতংকগ্রস্ত এবং লজ্জাশীল হৃদয় নিয়ে সে আল্লাহ তা'য়ালার সামনে দাঁড়িয়ে তাঁর ভালবাসা আর রুণা ভিক্ষা করছে।

সুতরাং বিষয়ে সন্দেহ নেই শরীরের খুশু মনের খুশু'কে অনুসরণ করে।

খুশুর কপটতা হল এটা প্রদর্শনের সাথে ভাণ করা যার অস্তিত্ব হৃদয়ে খুজে পাওয়া যায় না। একজন | সাহাবী (রাঃ) বলতেন, খুশু' মোনাফেকী হতে 'আমি আল্লাহর পানাহ চাই।কেউ তাকে খুশুর মোনাফেকী কি?” জিজ্ঞাসা করলে তিনি বললেন, উদের খুশুশরীরে দৃষ্টি গোচর হয় অথচ হৃদয়ে এর কোন অস্তিত্ব নেই।

সত্যিকারই যারা হৃদয়ে খুব অনুভব করে তারা কখনই দৈহিক প্রদর্শনে উদ্দীপ্ত বা অগ্নিবর্ণ হয় না। তাদের হৃদয় হয় পবিত্র এবং আল্লাহর মহিমার আলোকে আলোকিত।

ভয় এবং সম্ভ্রমে তাদের হৃদয় নদীর পানির মতো উপচে পড়ে; ফলতঃ তাদের সকল স্বার্থ এবং প্রদর্শন ইচ্ছা মরে যায় আর তাদের সকল শারীরিক ক্ষমতা আল্লাহর সামনে নিস্তেজ হয়ে পড়ে এবং আল্লাহর তরফ থেকে তাদের উপর নেমে আসে প্রশান্তি।

সেজন্যই তারা আল্লাহর সামনে সবসময় বিনয়ী থাকে। তারা নম্রতা বজায় রাখে কারণ তারা আল্লাহর ব্যাপারে সম্পূর্ণ নিশ্চিত নিঃসন্দিগ্ধ হয়েছে।

এই খুশু ওয়ালাদের তৃপ্ত হৃদয়টা হলো নীচু সমতল ভূমির মতো, যেখানে ধীরে ধীরে পানি প্রবাহিত হবার পর তা অত্যন্ত স্থির এবং শাক্ত ভাবে অবস্থান করে।

এটা তখনই হয় যখন একজন মানুষ সম্মান এবং দীনতার সাথে তার প্রভুর কাছে মস্তক অবনত করে এবং সে তার মস্তক উত্তোলন করে না যতক্ষণ না সে তাঁর প্রভুর সাথে সাক্ষাৎ করে। অন্যদিকে উদ্ধত বা অশিষ্ট হৃদয় অবজ্ঞায় পরিতৃপ্ত এবং তা একটি উঁচু জমিনের মতো যেখানে কখনই পানি স্থির ভাবে জমতে পারে না।

খুশুর বাড়াবাড়ি এবং ভন্ডামির ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, এই ধরণের মানুষের ভাব থাকে বড় খুশওয়ালার মত অথচ তার মনের গভীরটা থাকে নানা কামনা বাসনায় পূর্ণ বাহ্যিকভাবে তার মনের মধ্যে খুশু' আছে বলে মনে হয় কিন্তু সত্যিকার অর্থে এর মধ্যে বাস করে উপত্যকার সাপ এবং বনের সিংহ যারা শিকার ধরার জন্য অপেক্ষা করে ধূর্ততার সাথে। (আর রুহু -৩১৪)


প্রবন্ধটির পিডিএফ ডাউনলোড করুন 

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url