হৃদয় সতেজ করা কথামালা ”বিষন্ন হবেন না”
বিষন্ন হবেন না
দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী থেকে আল্লাহ তাআলা নিষেধ করেছেন, যেমন তিনি
ইরশাদ করেছেন-
وَلَا
تَهِنُوا وَلَا تَحْزَنُوا
‘আর তোমরা
নিরাশ হয়ো না এবং দুঃখিতও হয়ো না' [সূরা
আলে ইমরান : ১৩৯]
আরও বিভিন্ন স্থানে
ইরশাদ করেছেন-
وَلَا تَحْزَنْ
عَلَيْهِمْ
তাদের জন্য আফসোস করো
না। [সূরা নাহল : ১২৭]
لَا تَحْزَنْ إِنَّ
اللَّهَ مَعَنَا
বিষন্ন হয়ো না। আল্লাহ
আমাদের সঙ্গে আছেন। [সূরা তাওবা : ৪০]
এক স্থানে ইরশাদ
করেছেন- তাদের কোনো ভয় নেই এবং তারা দুঃখিতও হবে না।
বিষন্নতা কী? মনের উদ্যম কমে যাওয়া; হিম্মত দমে যাওয়া; কর্মস্পৃহা হ্রাস পাওয়া ।
এটি এমন এক ব্যাধি, যা মানুষের জীবনকে পঙ্গু করে দেয়।
এর রহস্য কী? বিষন্নতা কোনো ভালো লক্ষণ নয়। এতে অন্তরের কোনো কল্যাণ
নেই। মানুষকে বিষন্ন ও দুশ্চিন্তাগ্রস্ত করে সঠিক পথ থেকে বিচ্যুত করা ও
নিষ্ক্রিয় করে রাখা শয়তানের প্রিয়।
যেমন, ইরশাদ হয়েছে-
إِنَّمَا النَّجْوٰى مِنَ الشَّيْطٰنِ
لِيَحْزُنَ الَّذِينَ ءَامَنُوا
(মন্দ) প্ররোচণা
শয়তানের পক্ষ থেকে মুমিনদেরকে পেরেশান করার জন্য।' [সূরা মুজাদালা : ১০]
রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তিন ব্যক্তির মধ্যে একজনকে রেখে বাকি দু’জন কানাঘুসা করতে নিষেধ করেছেন। কারণ, এতে তৃতীয়জন মনে কষ্ট পাবে।
কোনো মুসলমান বিষন্ন
কিংবা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হোক শরীয়ত তা চায় না। কারণ, তার অশুভ প্রভাব পড়ে আত্মার উপর।
মুসলমানের কাছে
শরীয়তের দাবি হচ্ছে, দুশ্চিন্তা, পেরেশানী ও বিষন্নতাকে মনের ধারে কাছেও আসতে না দেওয়া। বরং
সফলভাবে তার মোকাবিলা করা ও বিজয় লাভ করা।
রসূলুল্লাহ
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তা থেকে আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন-
‘হে আল্লাহ! আমি আপনার
নিকট দুশ্চিন্তা, উদ্বিগ্নতা ও দুঃখ-বেদনা থেকে আশ্রয় কামনা
করছি।’
দুশ্চিন্তা-উদ্বিগ্নতা ও দুঃখ-বেদনার মাঝে পার্থক্য হল, ভবিষ্যতের কোনো দুর্ভাবনা
যদি আপনাকে পেরেশান করে, তা হলে তাকে বলা হয় দুশ্চিন্তা ও
উদ্বিগ্নতা। আর অতীতের কোনো ঘটনা বা দুর্ঘটনাকে কেন্দ্র করে যদি আপনি কষ্টবোধ করেন,
তা হলে তাকে বলা হয় দুঃখ-বেদনা। উভয়টিই মানুষের উন্নতির পথে
প্রতিবন্ধক। উভয়ই মনকে দুর্বল করে এবং ইচ্ছাশক্তিকে দমন করে।
দুশ্চিন্তা-পেরেশানীর কারণে জীবন অর্থহীন হয়ে
পড়ে। এ এমন এক বিষাক্ত জিনিস, যার দ্বারা আত্মায় বৈকল্য, অস্থিরতা ও নিষ্ক্রিয়তা
সৃষ্টি হয়। আপনি যত ভালো পরিবেশেই থাকুন না কেন, এ সবের
কারণে তা অন্ধকারাচ্ছন্ন মনে হবে। জীবনের সমস্ত হাসি-আনন্দ দুঃখ-বেদনায় পরিণত
হবে।
তবে হাঁ, এত কিছুর পরও যদি আপনি মানবীয় সহজাত প্রবৃত্তির কারণে পেরেশান ও
দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হয়ে পড়েন, তা হলে তা দোয়া ও যথার্থ
পন্থা অবলম্বনের মাধ্যমে দূর করার চেষ্টা করবেন। এতে ঘাবড়াবেন না।
দুশ্চিন্তা-পেরেশানীতে বান্দা সাওয়াবের অধিকারী হয়। কেননা, এটি একটি সহজাত বিষয় ।
দুনিয়াতে মানুষ পেরেশানী ও বিষন্নতার শিকার হতেই পারে।
কারণ, দুনিয়া পেরেশানীরই জায়গা।
পেরেশানী ও দুশ্চিন্তা থেকে পরিপূর্ণ ও সম্পূর্ণরূপে মুক্ত থাকার জায়গা তো হচ্ছে
জান্নাত। যেমন, জান্নাতীরা জান্নাতে প্রবেশ করার সময় বলবে
وَقَالُوا الْحَمْدُ
لِلَّهِ الَّذِىٓ أَذْهَبَ عَنَّا الْحَزَنَ ۖ
‘সমস্ত প্রশংসা আল্লাহ তাআলার জন্য, যিনি
আমাদের থেকে সব ধরনের দুশ্চিন্তা দূর করে দিয়েছেন।’ [সূরা ফাতির : ৩৪]।
এ থেকে এ কথা প্রমাণিত হয় যে, দুনিয়াতে তারা দুঃখ-কষ্ট ও
পেরেশানীতে ছিল। যেমন, মানুষের জীবনে এমন বহু মসিবত এসে থাকে,
যা তাদের ইচ্ছাধীন নয়।
অবশ্য
এখানে একটি প্রশ্ন হতে পারে যে, কুরআন-হাদীসে তো দুঃখ-বেদনা ও পেরেশানীর প্রশংসা করা হয়েছে। যেমন,
কুরআন বলছে-
وَلَا عَلَى الَّذِينَ إِذَا مَآ أَتَوْكَ لِتَحْمِلَهُمْ قُلْتَ لَآ أَجِدُ مَآ أَحْمِلُكُمْ عَلَيْهِ تَوَلَّوا وَّأَعْيُنُهُمْ تَفِيضُ مِنَ الدَّمْعِ حَزَنًا أَلَّا يَجِدُوا مَا يُنفِقُونَ
‘তাদেরও কোনো দোষ নেই, যারা এসেছিল আপনার নিকট যেন আপনি তাদের বাহন দান করেন, আর আপনি বলেছিলেন, আমার কাছে এমন কোনো বস্তু নেই যে,
তার উপর তোমাদের সওয়ার করাব। তখন তারা ফিরে গিয়েছিল এমতাবস্থায়
যে তাদের চোখ দিয়ে অশ্রু ঝরছিল এই দুঃখে যে, তারা এমন কোনো
বস্তু পাচ্ছে না যা ব্যয় করবে।' [সূরা তাওবা : ৯২]।
এর উত্তর হচ্ছে, এখানে দুঃখ-বেদনা কিংবা পেরেশানীর প্রশংসা করা হয়নি, বরং দুঃখ-বেদনায় ধৈর্য ধারণের জন্য প্রশংসা করা হয়েছে আর মুনাফিকদের
কটাক্ষ করা হয়েছে। অতএব, বুঝা গেল, সেই
দুঃখ-বেদনা ও পেরেশানী প্রশংসিত, যা কোনো কল্যাণকর ও নেক কাজ
করতে না পারার কারণে সৃষ্টি হয়। কারণ, তখনকার পেরেশানী ও
দুশ্চিন্তা এ কথা প্রমাণ করে যে, বান্দার দিল জীবিত।
এক হাদীসে বর্ণিত হয়েছে‘মুমিনের যে কোনো পেরেশানী, দুশ্চিন্তা ও দুঃখ-বেদনার ফলে আল্লাহ তাআলা তার গুনাহ মাফ করে দেন। এ থেকে
বোঝা যায়, দুশ্চিন্তা-পেরেশানী এক ধরণের মসিবত। বান্দা তাতে
ধৈর্য ধারণ করলে তা গুনাহের কাফফারা হয়ে যায়। কিন্তু তার অর্থ এই নয় যে,
দুশ্চিন্তা-পেরেশানী কোনো ভালো গুণ; যা অর্জন
করতে হবে। অতএব, বান্দা যেন দুশ্চিন্তা-পেরেশানী কামনা না
করে এবং তাকে ইবাদত ভেবে বসে। আর যেন এ কথা মনে না করে যে, নবীজী
সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জন্য উৎসাহিত করেছেন। এর আদেশ দিয়েছেন কিংবা
একে ভালো মনে করে ইবাদত সাব্যস্ত করেছেন।
যদি এমনই হত তা হলে রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া
সাল্লাম তার সারা জীবন দুশ্চিন্তা, পেরেশানী ও উদ্বিগ্নতায়ই কাটাতেন । অথচ তিনি হাসি-খুশি ও
আনন্দচিত্ত ছিলেন। তবে হাঁ, সেসমস্ত হাদীস ও বর্ণনা এ কথা
প্রমাণ করে যে, রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম
সব সময় পেরেশান ও চিন্তিত থাকতেন, সেখানে উদ্দেশ্য। হচ্ছে-
নবীজী সমগ্র উম্মতের হেদায়েত ও আখেরাতের চিন্তায় পেরেশান ও চিন্তিত থাকতেন।
দুনিয়াবী কোনো বিষয় বা স্বার্থের জন্য তিনি কোনো দিন কখনও
পেরেশান কিংবা বিষন্ন হননি।
যিনিই সীরাতে নববীকে গভীরভাবে অধ্যয়ন করবেন, তিনিই জানতে পারবেন যে,
রসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বাতিলকে ধ্বংস করার
জন্য এবং দুশ্চিন্তা, পেরেশানী ও মানসিক অস্থিরতা দূর করার
জন্য এসেছেন।
নফসকে শিরক, কুফর, সংশয়, সন্দেহ,
ও বিক্ষিপ্ততা থেকে মুক্ত করতে এবং বিপদ-আপদ ও বালা-মসিবত থেকে
রক্ষা করতে এসেছেন। এভাবে আল্লাহ তাআলা মানবতার উপর মহা অনুগ্রহ করেছেন।
মুমিনগণ সাধারণত দুনিয়াবী কোনো বিষয়ে পেরেশান কিংবা
বিষন্ন হন না। তাঁরা যদি কখনও বিষন্ন কিংবা চিন্তিত হন, তা হলে তা এ কারণে হন যে,
তাদের দ্বারা কোনো না কোনো গুনাহ হয়ে যায়; তারা
কোনো ভুল-ত্রুটি করে ফেলেন। পক্ষান্তরে গুনাহগার পাপীরা বিষন্নতা ও পেরেশানী ভোগ
করে দুনিয়া ও তার ফায়দা হাতছাড়া হয়ে যাওয়ার কারণে; প্রবৃত্তির
তাড়না ও নফসের বাসনা পূর্ণ না হওয়ার কারণে। এক কথায় তাদের দুশ্চিন্তা ও
পেরেশানীর পুরোটাই দুনিয়া কেন্দ্রিক।
সকল আরবাবে সুলুক তথা তাসাওউফের ইমামগণ এ বিষয়ে একমত যে, দুনিয়াবী পেরেশানী
অপছন্দনীয় ও নিন্দনীয়। তবে আবু উসমান আল জাবারী রহ. বলেছেন, পেরেশানী সর্বস্থায়ই মর্যাদাপূর্ণ ও মুমিনের জন্য কল্যাণকর; যদি তা কোনো গুনাহের কারণে না হয়। কারণ, পেরেশানী দ্বারা
‘তাখসীস’ তথা মর্যাদাবৃদ্ধি না হলেও তামহীস'
তথা পরিশুদ্ধ করা হয়।
তাঁর এ কথার ব্যাখ্যা হচ্ছে, নিঃসন্দেহে দুশ্চিন্তা ও পেরেশানী পরীক্ষার
মাধ্যম ও এক রকম মসিবত। তা রোগ-শোকের মতো। কিন্তু তা ‘সুলুক'
তথা আধ্যাত্মিক সাধনার
কোনো স্তর বা লক্ষ্য নয়। অতএব, আপনি সুখ, শান্তি ও প্রফুল্লতা অর্জন করুন। আল্লাহর কাছে সুন্দর জীবন, অন্তরের পরিশুদ্ধতা ও সুখ-শান্তি কামনা করুন। কারণ, নেয়ামত
খুব দ্রুত শেষ হয়ে যায়। কেউ কেউ তো বলেন, দুনিয়াতে একটি
জান্নাত আছে। যে এই জান্নাতে প্রবেশ করবে না, সে আখেরাতের
জান্নাতে প্রবেশ করবে না।
আসুন! আল্লাহর কাছে দোয়া করি- হে আল্লাহ! আমাদের বক্ষকে
ইয়াকীনের নূর দ্বারা ভরপুর করে দিন। আমাদের অন্তরকে সীরাতে মুসতাকীমের দিশা দান
করুন। আমাদেরকে সংকীর্ণ ও কষ্টকর জীবন থেকে মুক্তি দান করুন।