মু'আমালা ও মুআশারা এর গুরুত্ব -মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ
মু'আমালা ও মুআশারা-এর গুরুত্ব
-মাওলানা আবু তাহের মিছবাহ
ঈমান হচ্ছে ইসলামের মূল স্তম্ভ। তারপর ছালাত, যাকাত, ছিয়াম ও হজ্ব হচ্ছে ইসলামের চার রুকন; এগুলোর সম্পর্ক হচ্ছে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার।
ঈমানের মাধ্যমে আল্লাহর সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক স্থাপিত হয়, অর্থাৎ বান্দা আল্লাহর অস্তিত্ব স্বীকার করে এবং তার
যাবতীয় ছিফাত ও গুণাবলী স্বীকার করে। ব্যাপক অর্থে বান্দা আল্লাহর পরিপূর্ণ
আনুগত্য স্বীকার করে নেয়। তাই এগুলো হচ্ছে حقوق الله
বা আল্লাহর হক্ব।
পৃথিবীতে মানুষের জীবন হচ্ছে সামাজিক জীবন। কোন মানুষের
পক্ষে একা জীবন যাপন করা সম্ভব নয়।
মানবশিশু দুনিয়াতে আসার আগেই যার মায়া-মমতা, ত্যাগ ও আত্মত্যাগ সে গ্রহণ করে এবং যার অপরিসীম কষ্ট
স্বীকারের ফলেই সে পৃথিবীর মুখ দেখতে পায় তার নাম ‘মা’; যার দীর্ঘ প্রতিপালনের মাধ্যমে সে বড় হতে থাকে তিনি তার
‘মা’।
এসকল কষ্ট স্বীকার করার ক্ষেত্রে মাকে পূর্ণ সঙ্গ ও সহায়তা
দান করেন শিশুর বাবা। এভাবে মা ও বাবার বিরাট ইহসান ও অনুগ্রহ দ্বারাই সে
দুনিয়াতে আসে এবং বড় হয়।
তারপর আছে ভাই-বোন ও পরিবারের অন্যান্য সদস্য।
এভাবে জন্মসূত্রেই আমরা বিরাট একটা পারিবারিক বন্ধনে আবদ্ধ
হয়ে যাই। তারপর আসে বিভিন্ন সামাজিক বন্ধন। এসকল বন্ধন দ্বারা জীবনের চলার পথে
আমরা অনেক উপকৃত হই। ফলে অনিবার্যভাবেই পারিবারিক ও সামাজিক বন্ধনের কিছু
দায়দায়িত্ব আমাদের উপর বর্তায়।
এগুলোকে বলা হয় حقوق العباد বা বান্দার প্রতি
বান্দার হক।
ইসলাম যেহেতু একটি পূর্ণাঙ্গ জীবনবিধান। তাই হুক্কুল ইবাদ
বা বান্দার হক সম্পর্কেও রয়েছে ইসলামের সুনির্দিষ্ট বিধিবিধান, যা পালন করার মাধ্যমেই পূর্ণ মুমিন হওয়া সম্ভব।
ইসলামের দৃষ্টিতে হুক্কুল্লাহ বা আল্লাহর
হক্বের
গুরুত্ব যেমন বিরাট তেমনি হুক্কুল ইবাদ বা বান্দার হক্বের গুরুত্বও অনেক।
বরং এদিক থেকে হুক্কুল ইবাদের আলাদা গুরুত্ব এই যে, আল্লাহ তার নিজের হক যাকে ইচ্ছা মাফ করতে পারেন, কিন্তু বান্দার হক যদি বান্দা নিজে মাফ না করে, আল্লাহ তা মাফ করেন না। বান্দা নিজে মাফ করলেই শুধু মাফ হতে
পারে।
একটি হাদীছের ভাষ্য এই যে, বান্দা ছালাত, ছিয়াম ও ছাদাকা ইত্যাদি বহু নেক আমল নিয়ে হাশরের ময়দানে হাযির
হবে,
অর্থাৎ হুক্কুল্লাহ সে ঠিকঠাক আদায় করেছে, কিন্তু তার মুআমালা-মু'আশারা ঠিক ছিলো না। কারো হক মেরেছে, আমানতের খেয়ানত করেছে, কারো মনে কষ্ট দিয়েছে, কারো গীবত করেছে, ইত্যাদি। ফলে বহু মানুষ তার বিরুদ্ধে হকের দাবি নিয়ে দাঁড়াবে, আর আল্লাহ তা'আলা ইনছাফ করবেন এবং তার ছালাত, ছিয়াম ইত্যাদি নেক আমলগুলো হকদারদের দিতে থাকবেন। যখন আর কোন
নেক আমল বাকি থাকবে না তখন হকদারদের গোনাহ তার উপর চাপিয়ে দেয়া হবে। এভাবে সে গোনাহের
বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামের দিকে রওয়ানা হবে। [মুসলিম, হাদীছ নং ২৫৮১]
আফসোস, বহু দ্বীনদার মানুষ ছালাত-ছিয়ামের তো অনেক পাবন্দি করে, এমনকি বছরের পর বছর নফল হজ্ব করে, কিন্তু মু'আমালা-মু'আশারার
কোন ফিকির করে না, লেনদেনে হালাল-হারামের চিন্তা করে না, বান্দার হক দিন-রাত নষ্ট হচ্ছে, কিন্তু তার পরোয়া করে না। তো উপরের হাদীছ অনুযায়ী খুবই আশঙ্কা
আছে যে,
কেয়ামতের দিন অনেক আমল নিয়ে হাযির হওয়া সত্ত্বেও বান্দার
হক আদায় না করার কারণে তারা কাঙ্গাল হয়ে গোনাহের বোঝা মাথায় নিয়ে জাহান্নামে যাবে।
সুতরাং ইবাদতের যেমন ইহতিমাম করা কর্তব্য তেমনি কর্তব্য হলো
মু'আমালা-মু'আশারা বা বান্দার হক আদায়ের ফিকির করা।
মু'আমালা একটি
আরবী শব্দ, তবে মুসলিম
সমাজে খুব পরিচিত ও প্রচলিত শব্দ, যার মোটামুটি অর্থ হলো দুই বা আরো বেশী মানুষের মধ্যে যে কোন
প্রকার আর্থিক লেনদেন, যথা ক্রয়-বিক্রয়, শ্রম ও মজুরি বিনিময়, ভাড়া ও ইজারা, কর ও আমানত, মামলা-মোকদ্দমা, বিচার-আচার ও সাক্ষ্যপ্রদান ইত্যাদি।
তো মু'আমালার ক্ষেত্রেও ইসলামী শরী'আতের সুনির্দিষ্ট আহকাম ও বিধিবিধান রয়েছে, যার উদ্দেশ্য হলো আল্লাহর বান্দাদের প্রতিটি মু'আমালা যেন সততা ও সত্যবাদিতার সঙ্গে সম্পন্ন হয়; উভয়পক্ষ যেন লাভবান হয়; কেউ যেন কারো হক নষ্ট না করে।
প্রত্যেকে যেন অপরের হক পূর্ণরূপে আদায় করে; কেউ যেন কারো দ্বারা ক্ষতিগ্রস্ত ও প্রতারিত না হয়। এভাবে মুসলিম
সমাজ যেন শান্তির সমাজে পরিণত হয়।
ইসলামের দৃষ্টিতে তাকেই বলা হবে কামিল ও পূর্ণ মুমিন যার মু'আমালা হবে দ্বীন ও শরী'আতের পূর্ণ অনুগত।
পক্ষান্তরে কেউ যদি ছালাত-ছিয়াম তো পালন করে, এমনকি নফল ইবাদতও যথেষ্ট করে, কিন্তু মু'আমালার ক্ষেত্রে শরীআতের আহকাম পালন করে না, যেমন মাপে কম দেয়, জাল করে, ভেজাল মেশায়, ওয়াদাভঙ্গ করে, মিথ্যা বলে, আমানতের খেয়ানত করে, মিথ্যা মামলা দ্বারা হয়রানি করে, মিথ্যা সাক্ষ্য দেয়। সুদ-ঘুষ ও হারামের মাল ঘরে আনে, সে কিছুতেই খাঁটি মুমিন নয়, বরং মুনাফিক ও ফাসিক-ফাজির।
যার মু'আমালা খারাপ তার জন্য কোরআন-সুন্নায় এমন সব কঠিন আযাবের হুঁশিয়ারি এসেছে যা শুনলে
শরীর কাঁটা দেয় এবং বুক কেঁপে ওঠে।