আবু বকর (রাদি.) এর রাসূল প্রেমের অন্যন্য দৃষ্টান্ত -মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ
আবু বকর (রাদি.) এর রাসূল প্রেমের অন্যন্য দৃষ্টান্ত -মাওলানা শরীফ মুহাম্মাদ
তখন সময় ছিল কষ্টের। তখন সময় ছিল দুঃখের।
কাফেরদের অত্যাচারে সাহাবায়ে কেরাম জর্জরিত হয়ে যেতেন।
রক্তাক্ত হয়ে মাটিতে পড়ে থাকতেন। গরম বালিতে গড়াগড়ি দিয়ে চিৎকার করতেন। তাদের
শরীর থেকে রক্তের ধারা বয়ে যেত। দু'চোখ থেকে টপ টপ করে গড়িয়ে পড়তো ফোঁটা ফোঁটা অশ্রু। তবুও
তারা ইসলাম থেকে একচুল পরিমাণ সরে যেতে রাজী হতেন না।
তাদের ঈমান আরো মযবুত হয়ে যেত। তাদের বিশ্বাস আরো পোক্ত
হয়ে উঠতো। আল্লাহ, আল্লাহর রাসূলের প্রতি তাদের মহব্বত আরো বেড়ে যেত।
ইসলাম প্রচারের একদম প্রথম যুগের কথা। একজন, দু’জন করে সবেমাত্র ত্রিশ-চল্লিশজন মানুষ ইসলাম গ্রহণ
করেছেন। নিরবে-নিভৃতে সবাই ইসলাম গ্রহণ করেছেন। প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে ইসলামের
দাওয়াত তখনো শুরু হয়নি।
সকল সাহাবী এই অবস্থাটাকে মেনে নিতে পারতেন না। কেউ কেউ
নবীজীর দরবারে আবেদন জানালেন, “এবার আমরা ঘোষণা দিয়ে মানুষকে ইসলামের দাওয়াত দিতে চাই।
আপনি অনুমতি দিন।” মুসলমানের সংখ্যা যে খুবই কম নবীজী এই কথা সবাইকে বুঝালেন।
সবাইকে বললেন- আরো কিছু মানুষ ইসলাম গ্রহণ করুক। আরেকটু শক্তি বাড়ুক, তারপর প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াত দিলে ভালো হবে। কিন্তু
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) ও যখন বারবার আব্দার জানালেন, প্রকাশ্যে ইসলামের দাওয়াতের কথা নবীজীকে বললেন, তখন নবীজী (সা.) অনুমতি দিয়ে দিলেন । সবাই কাজে ঝাপিয়ে পড়লেন।
একদিন।
সাহাবীগণ সবাই মিলে মসজিদে হারামের আশে-পাশে ছড়িয়ে পড়লেন।
মানুষের কাছে ইসলামের দাওয়াত তুলে ধরতে লাগলেন।
মসজিদে হারামের চত্বরে সাহাবী গণের সাথে তাশরিফ নিয়ে আসলেন
স্বয়ং রাসূলে কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম।
মসজিদে হারামের চত্বরে তখন কাফের সর্দারদের আডড়া বসতো। মুশরেক
কবি সর্দাররা সেখানে বসেই অনেক আচার-বিচার করতো। কোন কিছু হলে সবাই সেখানেই সমবেত হতো। হযরত
রাসূলে করীম (রাঃ) এবং তার সাহাবীগণকে এই চত্বরে দেখতে পেয়ে তারা কেউ কেউ সতর্ক
হয়ে উঠলো। প্রস্তুত হয়ে গেল। তাদের দেব-দেবী, মূতীর বিরুদ্ধে। কোন কথা উচ্চারিত হলেই তারা বাধা দিবে।
হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এসময় কথা বলার জন্য দাঁড়ালেন।
বক্তৃতার মত করে তিনি সবাইকে আল্লাহ্ এবং আল্লাহর রাসূলের পথে এগিয়ে আসার জন্য
আহবান জানালেন। দেব-দেবী, মূর্তী ছেড়ে এক মা'বুদ
আল্লাহ্ তাআলার ইবাদতের দিকে সবাইকে ডাকলেন।
সঙ্গে সঙ্গেই বেঁধে গেল হৈ-চৈ । কাফের গুন্ডারা এসে
সাহাবীগণকে মারতে লাগল। চারিদিক থেকে এসে তারা মুসলমানদের উপর যেন ভেঙে পড়লো। আঘাতে
আঘাতে বহু সাহাবী ক্ষত-বিক্ষত হয়ে গেলেন।
মারের চোটে হযরত আবু বকর (রাঃ) মাটিতে পড়ে গেলেন। কয়েকজন
কাফের এসে তাকে চড়, লাথি,
কিল, ঘুষি মারতে লাগল।
উতবা ইবনে রবীআ' এক দাঙ্গাবাজ কাফের। ভীড়ের মধ্য থেকে এসে
সে হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর সামনে দাড়ালো। তার
পায়ে মোটা চামড়ার
জুতা। সেই জুতা দিয়ে হযরত আবু বকর (রাঃ) এর মুখে আর পেটে সমানে লাথি মারতে শুরু
করল। লাথির আগাতে তাঁরা শরীর রক্তাক্ত হয়ে গেল। নাক আর মুখ হয়ে গেল একাকার।
তিনি অজ্ঞান হয়ে গেলেন। মসজিদুল হারামের চত্বরে নিথর হয়ে পড়ে
রইলো হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর দেহ।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর গোত্রের লোকজন খবর পেয়ে ছুটে এলো। তাদের
দেখে আক্রমণকারী কাফেররা সরে গেল।
তারা একটি কাপড় দিয়ে হযরত আবু বকর সিদ্দীক (রাঃ) এর
রক্তাক্ত শরীরটা পেচিয়ে
বাড়ীতে নিয়ে এলো।
হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পরিবারের সবাই আবু বকরের এই দশা দেখে
আঁৎকে উঠলেন। সবাই
মিলে রক্তাক্ত আবু বকরের সেবা করতে লাগলেন। অজ্ঞান আবু বকরকে দেখে অনেকেই মনে
করেছিলেন,
তিনি মারা গেছেন। আর কোনদিন তিনি কথা বলবেন না।
সারা বেলা আবু বকর (রাঃ)-এর আব্বা তাঁকে ডাকলেন, জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু বেহুশ আবু বকর মুখ খুলে কোন কথারই
জবাব দিতে পারলেন না।
সেইদিন সন্ধ্যায় হযরত আবু বকর (রাঃ) এর পূর্ণ হুঁশ ফিরে এলো। তার
মুখের কাছে মুখ নিয়ে সবাই তাঁর কথা শুনতে চাইলেন। শরীরের কোথাও কোন কষ্ট হচ্ছে
কিনা,
কোন কিছু লাগবে কিনা-এসব জানার জন্য সবাই যখন উন্মুখ, তখন সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি ভাঙা ভাঙা উচ্চারণে
বললেন-“রাসূলুল্লাহু (সাঃ) কেমন আছেন?”
হযরত আবু বকর (রাঃ)-এর খান্দানের অনেকেই তখনো মুসলমান হননি।
এই কথা শুনে কেউ কেউ বিরক্ত হলেন। অসন্তুষ্ট হয়ে কেউ কেউ উঠে গেলেন।
উন্মুখায়ের ছিলেন আবু বকর (রাঃ)-এর মা। মায়ের মন বড় নরম
মন। তার মা তাঁর পাশে বসলেন। বারবার খানা-পিনার কথা জিজ্ঞাসা করলেন। কিন্তু হযরত
আবু বকর (রাঃ)-এর মুখে একই কথা“রাসূলুল্লাহ (সাঃ) এখন কেমন আছেন? তিনি কি নিরাপদ আছেন?"
মা বুঝতে পারলেন, রাসূল মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের সঙ্গে
দেখা করতে না পারলে তার সন্তানের প্রাণ ঠান্ডা হবে না। বহু কষ্ট করে রাতের
অন্ধকারে দুজনের কাধে ভর করে আবু বকর (রাঃ) নবীজীর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গেলেন।
ক্ষত-বিক্ষত বন্ধু আবু বকর (রাঃ)-কে দেখে রাসূলে আকরাম
(সাঃ) -এর অন্তর ব্যথিত হয়ে উথলে উঠলো। তিনি আবু বকর (রাঃ)-কে জড়িয়ে ধরলেন। আবু বকর (রাঃ)-কে
চুমু খেলেন।
প্রশান্তিতে ছেয়ে গেলো আবু বকর (রাঃ)-এর হৃদয়, মন, গোটা দেহ। কষ্টের কথা, আঘাতের কথা বেমালুম ভুলে গেলেন।