ছালাতে কিয়াম (দাড়ানো) ও রুকু-সিজদার হাকীকত বা মর্মকথা

 

ছালাত শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত দাসত্বের এবং শোকর ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ

শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত ছালাত হচ্ছে আমার খালিক ও মালিক আল্লাহ রাব্বুল ইজ্জতের সামনে আমার বান্দেগি ও আবদিয়াতের, দীনতা ও দাসত্বের এবং শোকর ও কৃতজ্ঞতার প্রকাশ। 

কিয়াম, রুকু-সিজদা ও বৈঠক, তথা ছালাতের প্রতিটি রোকনের মাধ্যমে বান্দার এই আবদিয়াত ও কৃতজ্ঞতারই প্রকাশ ঘটানো হয়েছে এবং তা আল্লাহ তা'আলার খুব প্রিয়।

সুতরাং বান্দা যখন ছালাতের জন্য কিবলামুখী হয়ে দাঁড়ায় তখন তার অন্তরে এই চেতনা যেন জাগ্রত থাকে যে, একজন কৃতার্থ বান্দা হিসাবে সে তার দয়ালু মালিকের সামনে দাঁড়িয়েছে।

এই ছালাত তার ইচ্ছার বিরুদ্ধে তার উপর চাপিয়ে দেয়া কোন আদেশ নয়, বরং এটা তার রূহ ও আত্মারই আকুতি।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত সে যে আল্লাহ তাআলার অসংখ্য নেয়ামতের মধ্যে ডুবে আছে সে জন্য তার রূহ ও আত্মা ব্যাকুল ছিলো আল্লাহ তা আলার প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতা নিবেদন করার জন্য। কিন্তু তার জানা ছিলো না, কীভাবে সে আল্লাহর প্রতি শোকর ও কৃতজ্ঞতা নিবেদনের মাধ্যমে নিজের জীবন ও অস্তিত্বকে ধন্য করবে; কৃতার্থ করবে।

সে ব্যাকুল ছিলো, অস্থির ছিলো, দিশেহারা ছিলো এবং তার ভিতরে গভীর একটা দহন ও যন্ত্রণা ছিলো

বান্দাকে সেই যন্ত্রণা থেকে উদ্ধার করার জন্য এবং বান্দাকে আবদিয়াত, শোকর ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশের মাধ্যমে আত্মিক শান্তি ও প্রশান্তি লাভ করার উপায় করে দেয়ার জন্যই তার উপর ছালাতের ফরযিয়াত নাযিল করা হয়েছে।


কিয়াম তথা (সালাতে দাড়ানো) ‘র মর্মকথা

কিয়ামের মাধ্যমে বান্দা যেন তার বান্দেগি ও আবদিয়াত নিবেদনের সূচনা করছে। কেয়ামের মধ্যে বান্দা যদি নীরবে শুধু দাঁড়িয়ে থাকতো তাহলে হয়ত বান্দেগি আদায় হতো, কিন্তু তার রূহের পিয়াস ও আত্মার পিপাসা দূর হতো না। দয়াময় আল্লাহ তো ছালাতের মাধ্যমে বান্দার কাছ থেকে আসলে কিছুই পেতে চান না, বরং বান্দাকে দান করতে চান। কী দান করতে চান? বান্দেগির স্বাদ ও শান্তি এবং আবদিয়াতের সুকূন ও সাকীনা! তাই বান্দাকে তিনি সূরাতুল ফাতিহা এবং সেই সঙ্গে কোরআনের কিছু আয়াত তেলাওয়াত করার আদেশ করেছেন, যাতে বান্দা তার বান্দেগি প্রকাশ করার সঙ্গে সঙ্গে রূহের গিযা (খাদ্য) এবং আত্মার খোরাকও হাছিল করতে পারে।

সূরাতুল ফাতিহা তো আর কিছু না, বান্দার নিজের যাবতীয় হাজাত ও প্রয়োজনেরই শুধু প্রার্থনা ও মুনাজাত। সেখানেও আল্লাহ বান্দার প্রতি কত দয়া করেছেন!

ছালাতে কিয়ামের অবস্থায় বান্দা যখন সূরাতুল ফাতিহা তিলাওয়াত করে তখন আল্লাহ বান্দার প্রতিটি কথার উত্তর দেন। যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে, বান্দা যখন বলে الحمد لله رب العلمين তখন আল্লাহ তাআলা বলেন حمدنى عبدى আমার বান্দা তো আমার প্রশংসা করেছে!

বান্দা যখন বলে الرحمن الرحيم তখন আল্লাহ বলেন أثنى على عبدى আমার বান্দা তো আমার গুণ বর্ণনা করেছে!

বান্দা যখন বলে ملك يوم الدين তখন আল্লাহ বলেন مجدنيى عبدى আমরা বান্দা তো আমার গৌরব বর্ণনা করেছে!

আর বান্দা যখন বলে : اياك نعبد واياك نستعين তখন আল্লাহ তা'আলা বলেনهذا بينى وبين عبدى  এটা হলো আমার মধ্যে এবং আমার বান্দার মধ্যে, আর আমার বান্দা যা চেয়েছে অবশ্যই সে তা পাবে। (মুসলিম, ছালাত, হাদীছ নং ৩৯৫)

কিয়ামের অবস্থায় আপনি যদি অন্তরে এ অনুভব-অনুভূতি লালন করতে পারেন যে, আপনি আবদিয়াত নিবেদন করছেন, আর আল্লাহ খুশী হয়ে তা কবুল করছেন এবং আপনার কথার উত্তরে কথা বলছেন তাহলে সেই ছালাতের, সেই কিয়ামের স্বাদই তো হবে অন্য রকম! আল্লাহ তাওফীক দান করুন, আমীন।


রুকু‘র মর্মকথা

কিয়াম হলো আল্লাহর দরবারে বান্দার বান্দেগি প্রকাশের প্রথম ধাপ। এই ধাপটি উত্তমরূপে অতিক্রম করার পর সে বান্দেগির দ্বিতীয় ধাপে প্রবেশ করে, অর্থাৎ দিলের মধ্যে আল্লাহ তা'আলার বড়াই ও বড়ত্বের ধেয়ান করতে করতে আল্লাহু আকবার বলে রুকূতে যায়। রুকূর তাছবীহ হলো-

سبحان ربي العظيم  আমার মহান প্রতিপালক চিরপবিত্র।

এ সময় বান্দার কর্তব্য হলো, যা সে মুখে বলছে তার ভাব ও মর্ম এবং হাকীকত ও কায়ফিয়াত অন্তরেও যেন ধারণ করে। তবেই সে আবদিয়াত ও বান্দেগির আরো উর্ধ্বস্তরে এবং একসময় সর্বোচ্চ স্তরে উপনীত হতে সক্ষম হবে।


সিজদা‘র মর্মকথা

রুকু থেকে সরাসরি সিজদায় চলে যাওয়ার পরিবর্তে বিধান হলো সামি‘আল্লাহু লিমান হামিদাহ বলে আবার কিয়ামের হালাতে ফিরে আসা, তারপর আল্লাহু আকবার বলে সিজদায় যাওয়া। কারণ- সিজদা হলো আবদিয়াত ও বান্দেগি প্রকাশের সর্বোচ্চ স্তর। সুতরাং সেজন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি গ্রহণের প্রয়োজন। সিজদার মাধ্যমে বান্দা আল্লাহ তা'আলার সর্বোত্তম সান্নিধ্য লাভ করে, যেমন হাদীছ শরীফে এসেছে। [মুসলিম, ছালাত (বাবু মা ইয়াকূলু ফিস্-সুজুদ), হাদীছ নং ৪৮২]

বাহ্যত যদিও দেখা যায় যে, বান্দা যমিনের উপর সিজদা করছে, কিন্তু প্রকৃতপক্ষে সে আল্লাহ তা'আলার কুদরতি ‘সাক’-এর উপর সিজদা করে এবং আল্লাহর প্রিয় বান্দারা তো কুদরতি ‘সাক’-এর ঠাণ্ডকও অনুভব করে।

এজন্যই হাদীছে এসেছে, কেয়ামতের দিন আমাদের রাব্ব তার কুদরতি সাক প্রকাশ করবেন, আর মুমিন সিজদা করবে, কিন্তু দুনিয়াতে যারা প্রকৃত সেজদা করেনি, বরং লোকদেখানো সেজদা করেছে, তারা ইচ্ছা করবে, কিন্তু সেজদা করতে পারবে না। (বুখারী, নং ৪৯১৯)

সিজদা করার সময় বান্দার অন্তরে এরূপ কিছু অনুভব-অনুভূতি জাগ্রত থাকতে হবে। তাহলেই সে সিজদার প্রকৃত লয্যত ও স্বাদ অনুভব করতে পারবে।

সিজদার তাসবীহ হলো

سبحان ربي الأعلى - আমার সর্বোচ্চ প্রতিপালক চিরপবিত্র।

ছালাতের মধ্যে যেহেতু সিজদাই হলো বান্দেগির সর্বোচ্চ স্তর সেহেতু তাসবীহের মধ্যেও সর্বোচ্চ শব্দটি ব্যবহার করা হয়েছে। সুতরাং এই তাসবীহ উচ্চারণের সময় দিলের মধ্যে এই চিন্তা-ধেয়ান সর্বোচ্চ পরিমাণে জাগরূক থাকা চাই যে, আমাদের প্রতিপালক কত মহান, কত ‘গনী (ধনী) ও বে-নেয়ায’(নিমুখাপেক্ষী), আর বান্দা কত অসহায়, অভাবী ও মুহতাজ!

মাসকানাত (মিসকীন অবস্থা) ও মুহতাজি (মুখাপেক্ষী) ’র এ অনুভূতি যত বেশী জাগ্রত হবে সিজদা তত বেশী জানদার ও যিন্দা হবে এবং সিজদার ফায়য (পূণ্য) ও ফায়যান (অধীক কল্যাণ) তত বেশী অর্জিত হবে, ইনশাআল্লাহ।

কিয়াম ও রুকু-সিজদা সম্পর্কে যা কিছু এখানে বলা হলো আল্লাহ যেন ছালাতের মধ্যে আমাদের তেমনি জানদার কেয়াম ও যিন্দা রুকু-সিজদা করার তাওফীক দান করেন, আমীন।


সালাতে আখেরি বৈঠকের মর্মকথা

আখেরি বৈঠক হলো ছালাতের সমাপ্তিপর্ব, আর এখানে তাহিয়্যাতের মধ্যে যেন ছালাতের খোলাছা ও সারনির্যাস পেশ করা হয়েছে।

বান্দার সমস্ত গান্দেগি ও নালায়েকি সত্ত্বেও আল্লাহ তাআলা তাকে ছালাত আদায়ের তাওফীক দান করেছেন। তাই বান্দার কর্তব্য হলো তাহিয়্যাতের মাধ্যমে তাওফীকে ছালাতের উপর শোকর আদায় করা।

তাই সে কৃতজ্ঞচিত্তে বলে


আদব ও তাযীম এবং ভক্তি ও ফারমাবরদারির সমস্ত বক্তব্য আল্লাহ তাআলারই জন্য এবং (আল্লাহরই জন্য) সমস্ত ইবাদত এবং সমস্ত ছাদাকাহ।

উম্মতে মুহাম্মাদী ছালাতের এ মহান নেয়ামত লাভ করেছে আল্লাহর পেয়ারা হাবীব হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে। মিরাজের পবিত্র রাত্রে তিনি যখন আল্লাহর আদেশে আল্লাহর সান্নিধ্যে গমন করেন তখন আল্লাহ তাঁকে ছালাতের নেয়ামত দান করেন এবং তিনি তা উম্মতের জন্য বহন করে আনেন। ছালাত হলো উম্মতের জন্য নবীজীর তোহফা!

প্রত্যেক উম্মতই নবীর কাছ থেকে কোন না কোন তোহফা লাভ করেছে, যেমন মূসা আলাইহিস-সালামের মাধ্যমে মান্না-সালওয়া এবং ঈসা আলাইহিস-সালামের মাধ্যমে মাঈদাহ ও দস্তরখান।

কিন্তু পূর্ববর্তী কোন উম্মত তার নবীর কাছ থেকে ছালাতের মত এত উচ্চ মরতবার তোহফা লাভ করেনি। সুতরাং পিয়ারা উম্মতির কর্তব্য হলো পেয়ারা নবীর প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা। তাই সে ভক্তিবিগলিত হৃদয়ে নবীকে সালাম পেশ করে


হে নবী, আপনার প্রতি সালাম ও শান্তি এবং আল্লাহ তা'আলার পক্ষ হতে

রহমত ও বরকত।

আল্লাহ তা'আলা কত মেহেরবান! পেয়ারা নবীর মাধ্যমে তিনি নিজেই শিখিয়ে দিয়েছেন যে, হে বান্দা! কবুলিয়াতের এ মোবারক সময়ে তুমি নিজের প্রয়োজনের কথা ভুলে যেয়ো না। তুমি তোমার নিজের জন্য এবং আমার নেক বান্দাদের জন্য সালাম ও শান্তি প্রার্থনা করো, যাতে তুমি নিজেও নেক বান্দাদের অন্তর্ভুক্ত হতে পারো

তাই সে নবীর প্রতি সালাম নিবেদন করার পর নিজের জন্য এবং নেক বান্দাদের জন্য এভাবে প্রার্থনা করে


সালাম ও শান্তি বর্ষিত হোক আমাদের প্রতি এবং আল্লাহর নেক বান্দাদের

প্রতি।

খাতেমা বিলখায়র, অর্থাৎ তাওহীদ ও রিসালাতের প্রতি ঈমানের সঙ্গে মউত নছীব হওয়া, এটাই হলো মুমিনের যিন্দেগির একমাত্র লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য। ঈমানের উপর খাতেমাই হলো গ্রহণযোগ্য।

ঈমানের উপর যার খাতেমা হবে সে কামিয়াব, আর ঈমানের উপর যার খাতেমা হবে না সে বরবাদ। তাই ছালাতেরও খাতেমা করা হলো তাশাহহুদ-এর পবিত্র কালিমার মাধ্যমে


আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া নেই কোন ইলাহ এবং আমি সাক্ষ্য

দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ হচ্ছেন আল্লাহর বান্দা ও রাসূল।

বান্দা যখন ছালাতের এই দীর্ঘ-কঠিন মুজাহাদা থেকে ফারেগ হবে তখন তার অন্তরে যেন ইবাদতের অহঙ্কার সৃষ্টি না হয়, বরং যেন এই সলজ্জ অনুভতি বিরাজ করে যে, যেভাবে ছালাত আদায় করা দরকার ছিলো সেভাবে আল্লাহ তাআলার শায়ানে শান ছালাত আদায় করা তার পক্ষে সম্ভব হয়নি।

অনেক ত্রুটিবিচ্যুতি তাতে রয়ে গেছে। এখন আল্লাহ তা'আলা যদি দয়া করে তার ত্রুটিপূর্ণ ছালাত ও ইবাদত কবুল করে নেন তাহলেই সে কামিয়াব। তাই দু'আ ও ইসতিগফারের মাধ্যমে সেই মিনতিটুকুই সে নিবেদন করে আল্লাহর দরবারে।


হে আল্লাহ, (ছালাতের ভিতরে এবং ছালাতের বাইরে) আমি নিজের নফসের উপর অনেক যুলুম করেছি, আর আপনি ছাড়া কেউ পারে না। গোনাহ মাফ করতে।

সুতরাং আপনার পক্ষ হতে আমাকে মাগফিরাত দান করুন এবং আমার প্রতি রহম করুন। নিঃসন্দেহে আপনিই পরম ক্ষমাশীল ও পরম করুণাময়।

এই হলো সেই ছালাত যার মধ্যে রাখা হয়েছে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের চোখের ঠান্ডক ও শীতলতা। উঠক-বৈঠকওয়ালী’ ছালাত হয়ত আমরা আদায় করতে পারি, তবে আল্লাহ যেন দয়া ও রহম করে নবীর চোখের ঠান্ডকওয়ালি ছালাত আমাদের সবাইকে নছীব করেন এবং কবুল করেন, আমীন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url