সূরা বাকরার নামকরণ, নাযিলের সময়কাল ও নাযিলের উপলক্ষ

 সূরা বাকারার নামকরণ

সূরাটির নাম 'বাকারা' এজন্য রাখা হয়েছে যে, এতেবাকারা' (গাভী) সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনা উল্লেখিত আছে।

কুরআন মাজীদের প্রায় প্রতিটি সূরাতেই অনেক সংখ্যক বিষয় আলোচিত হয়েছে। সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সূরার শিরোনাম গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এজন্য রাসুলুল্লাহ (স) আল্লাহর নির্দেশে সূরাগুলোর বিষয় ভিত্তিক শিরোনামের পরিবর্তে শুধুমাত্র পরিচিতির স্বার্থে বা চিহ্ন স্বরূপ নামকরণ করেছেন।

এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো—এটা সেই সূরা যাতে বাকারা' তথা গাভীর উল্লেখ আছে।

 

সূরা বাকারা নাযিলের সময়কাল

এ সূরার অধিকাংশই মহানবী (স)-এর মাদানী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছে। কিছু অংশ পরবর্তীকালে নাযিল হয়েছে। সূরার শেষের দিকের কিছু আয়াত হিজরতের পূর্বে মক্কায় নাযিল হয়েছে। বিষয়বস্তুর মিল থাকার কারণেই বিভিন্ন পর্যায়ে নাযিলকৃত অংশসমূহকে একই সূরার অধীনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।

 

সূরা বাকারা নাযিলের উপলক্ষ

এ সূরাটির তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য নাযিলের সময়কালীন সার্বিক অবস্থা

সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার।  

 

এক : হিজরতের পূর্বে কুরআন মাজীদের নাযিলকৃত আয়াতসমূহে সম্বোধন করা হয়েছিল মুশরিক তথা মূর্তিপূজারীদেরকে এবং সেই আলোকেই আলোচনা অব্যাহত ছিল। কিন্তু হিজরত পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানদেরকে ইয়াহুদীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ইয়াহুদীরা হযরত মূসা (আ) কর্তৃক প্রচারিত ইসলাম থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল। তারা তাওরাতের শিক্ষাকে ভুলে গিয়ে নিজেদের মনগড়া নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই চলছিল। তাদের মধ্যে সর্বস্তরেই নানাবিধ বিকৃতি এসে গিয়েছিল । তাদের সমাজ নেতা, ধর্মীয় নেতা, আম জনসাধারণ কেউই এ বিকৃতি থেকে নিরাপদ ছিলো না।

যেহেতু সকল নবীর প্রচারিত জীবনব্যবস্থাই ছিল ইসলাম, সেহেতু মূসা (আ)-এর অনুসারী হিসেবে তারাও প্রথমত মুসলিম ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে নিজেদের মুসলিম না বলে ইয়াহুদী বলা শুরু করেছিল।

অতপর রাসূলুল্লাহ (স) যখন মদীনায় হিজরত করে আল্লাহর নির্দেশে ইয়াহুদীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তখন তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল।

সূরার প্রথম দিকের ১৫/১৬ রুকু পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইয়াহুদীদের সমালোচনা ও

তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াতের বিষয়ই আলোচিত হয়েছে।

 

দুই:  হিজরতের পূর্বে দীনী তাবলীগ এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের ব্যক্তি পর্যায়ের

শিক্ষা এবং চারিত্রিক সংশোধনের পর্যায় পর্যন্তই ইসলাম সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু হিজরতের পর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন, আর্থ-সামাজিক নিয়ম-নীতি, আইনকানুন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক আয়াতও অবতীর্ণ হচ্ছিল। এ সূরার শেষ দিকের ২৩টি রুকুতে এ সম্পর্কিত আলোচনাই অধিক রয়েছে।

 

তিন : মক্কার কাফিরদের আয়ত্তাধীন এলাকাতেই ইসলাম-এর সূচনা হয়েছিল ; যারা মুসলমান হচ্ছিল তারা নির্বিবাদে কাফিরদের অমানুসিক অত্যাচার-নির্যাতন সয়ে যাচ্ছিল কোনো প্রকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও তাদের ছিল না, আর আল্লাহর নির্দেশও ছিল না, কিন্তু যখনই মদীনায় হিজরত করে মুসলমানগণ একটি ঐক্যজোটে পরিণত হলো, একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা সুস্পষ্টরূপে দেখা দিল, মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগলো, তখনই কাফিরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদেরকে নির্মূল করার চেষ্টাও জোরদার হতে লাগল। এ বিশাল শক্তির সঙ্গে দ্বন্দ্বে লিপ্ত হয়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব ছিলো না, যদি না আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে এ সূরার নিম্নোক্ত পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ দিতেন ?

 (ক) পূর্ণ শক্তি ও উদ্যম প্রয়োগে নিজেদের জীবনব্যবস্থার নিয়ম-নীতিকে প্রচার করে যতো বেশী সম্ভব লোককে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।

(খ) বিরুদ্ধ কাফির শক্তির ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা সম্পর্কে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে। তাকে পরিত্যাজ্য প্রমাণ করা।

(গ) নিরাশ্রয়, দরিদ্র ও প্রবাসী হওয়ায় মুসলমানগণ যে নিরাপত্তাহীন ও সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তাতে ধৈর্য, ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবিলা করা।  

(ঘ) ক্রমাগ্রসরমান এ দীনী দাওয়াতকে থামিয়ে দেয়া বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিরোধীদের শক্তি, জনবল, সাজ-সরঞ্জাম প্রভৃতির প্রতি কোনো প্রকার তোয়াক্কা না করে তাদের মোকাবিলা করার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা।

(ঙ) মুসলমানদের মনে এতটুকু শক্তি-সাহসের সঞ্চার করে দেয়া যে, যদি পৌত্তলিক আরবগণ এ সত্য দীন তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থাকে গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের জাহেলিয়াতের বিপর্যয়কর জীবনব্যবস্থাকে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।

 

চার : দাওয়াতে ইসলামীর এ মাদানী পর্যায়েই মুনাফিক শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটতে লাগলো। অবশ্য মক্কাতেও মুনাফিকদের একটি শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এ শ্রেণীর মুনাফিকরা ইসলামকে সত্য ও কল্যাণময় জীবন বিধান হিসেবে মানতো।

ইসলামের সত্যতা তারা মুখে ঘোষণাও করতো; কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করে সমাজচ্যুত হতে তারা রাজী ছিল না।

মদীনাতে মুনাফিকদের এ শ্রেণী তত ছিলই, অধিকন্তু সেখানে আরো চার শ্রেণীর মুনাফিকের প্রকাশ ঘটেছিল

(১) একদল আসলেই কাফির ও ইসলামের দুশমন ছিল ; কিন্তু ইসলামের ক্ষতি করার মতলব নিয়ে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।

(২) দ্বিতীয় একদল মুনাফিক ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে মুসলমান পরিবেষ্টিত ছিল। তারা মুসলমান পরিচয়ে এবং ভেতরে ভেতরে কাফিরদের সাথে সম্পর্ক রাখার মধ্যে নিজেদের কল্যাণ মনে করতো।

(৩) তৃতীয় একদল ছিল যারা ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিসন্দেহ ছিল না। তাদের গোত্র বা বংশের লোকদের সাথে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়েছিল।

(৪) চতুর্থ আর একদল মুনাফিক ইসলাম যে সত্য ও সনাতন জীবনব্যবস্থা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণও করেছিল; কিন্তু জাহেলী সমাজের বল্গাহীন জীবন আচার ত্যাগ করে ইসলামী বিধি-বিধান পালন এবং বিভিন্ন দায়িত্ব-কর্তব্য পালনকে নিজেদের জন্য বোঝা মনে করে তা পালন করতে চাইতো না। এ শ্রেণীর মুনাফিকদের প্রকাশ লগ্নেই সূরা আল বাকারা নাযিল হয়েছিল। তাই সূরার বিভিন্ন আয়াতে মুনাফিকদের ব্যাপারে আল্লাহ তায়ালা সংক্ষিপ্ত ইংগিত করেছেন।

 

ট্যাগ :  আল্ কুরআন, আল কুরআনের তথ্য, সূরা আল বাকরা, সূরা বাকারার নামকরণ, ইসলাম, বাংলা


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url