উম্মতের বৈশিষ্ট্য, নবীপ্রেম
যে কোন ধর্মসম্প্রদায় তাদের ধর্মগুরুর প্রতি স্বাভাবিকভাবেই ভক্তি, ভালোবাসা ও মুহব্বত পোষণ করে থাকে। তবে মুসলিম উম্মাহ তার অন্তরের গভীরে আপন নবীর প্রতি যে ইশক ও মুহব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসা পোষণ করে তার কোন তুলনা পথিবীর অন্য কোন জাতি ও ধর্মের ইতিহাসে নেই। এটাই স্বাভাবিক; কারণ হাদীছ শরীফে নবীর প্রতি মুহব্বতকে সকল মুহব্বতের উপর অগ্রাধিকার দেয়াকে ঈমানের পূর্ণতার শর্তরূপে ঘোষণা করা হয়েছে।
হযরত আনাস রা. হতে বর্ণিত যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন
لا يؤمن أحدكم حتى أكون أحب إليه من والده وولده والناس أجمعين
তোমাদের কেউ (পূর্ণ) মুমিন হতে পারবে না যতক্ষণ না আমি তার কাছে তার পিতা এবং তার সন্তান এবং সমস্ত মানুষ থেকে অধিক প্রিয় হবো। [বোখারী, হাদীছ নং ১৫; মুসলিম, হাদীছ নং ৪৪]
সাহাবায়ে কেরাগণই রাসূল (সা.) কে বেশি ভালোবাসতেন
বলাবাহুল্য যে, দ্বীনের অন্যান্য ক্ষেত্রে যেমন তেমনি নবীপ্রেমের ক্ষেত্রে ছাহাবা কেরামই ছিলেন শ্রেষ্ঠ। তাদের নবীপ্রেমই হচ্ছে উম্মতের জন্য আদর্শ। কেমন ছিলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের প্রতি ছাহাবা কেরামের ইশক ও মুহব্বত এবং প্রেম ও ভালোবাসা? এসম্পর্কে খুব সংক্ষেপে লিখতে গেলেও আলাদা এক দফতর হয়ে যাবে। এখানে শুধু নমুনা হিসাবে দু'একটি ঘটনা উল্লেখ করি।
রাসূল (সা.) এর প্রতি
সাহাবাদের ভালোবাসার তিনটি ঘটনা
(ক) হিজরতের সময় হযরত আবু বকর রা. ছিলেন নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সঙ্গী। গারে ছাওরে তিন দিন তারা আত্মগোপন করে ছিলেন, যার উল্লেখ কোরআনেও এসেছে। সেখানে একপর্যায়ে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হযরত আবু বকর রা.-এর উরুতে মাথা রেখে ঘুমিয়ে ছিলেন। এমন সময় বিষাক্ত কিছু হযরত আবু বকর রা.-এর পায়ে দংশন করে, কিন্তু তিনি একটুও নড়াচড়া করেননি, যাতে প্রিয় নবীর ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে। দেখুন, জীবন চলে যাওয়ার আশঙ্কা, তবু প্রিয়তমের ঘুমের সামান্য ব্যাঘাতও বরদাতযোগ্য নয়! [বায়হাকী,
দালায়েলুন নবুওয়াহ ২/৪৭৭]
(খ) হযরত খাব্বাব রা. এর ঘটনা তো প্রসিদ্ধ। শূলে চড়ানোর সময় মজা করার উদ্দেশ্যে কোরায়শগন তাকে জিজ্ঞেস করলো, হে খাব্বাব, তুমি কি রাজী যে, মুহম্মদ তোমার স্থানে হবেন, আর তুমি ঘরে আপন পরিবারপরিজনের মধ্যে হবে? হযরত খাব্বাব রা. শূলে বিদ্ধ অবস্থায় সঙ্গে সঙ্গে জবাব দিলেন, আল্লাহর কসম, আমার তো এতটুকুও পছন্দ নয় যে, আমি জান বাঁচাবো, আর তার পায়ে সামান্য একটি কাটাও বিধবে! কোরায়শের সরদার আবু সুফয়ান (তখনো অমুসলিম) এ উত্তর শুনে বলে উঠলেন, আল্লাহর কসম, মুহম্মদের সঙ্গীরা তাকে যেমন ভালোবাসে তেমন করে কেউ কাউকে ভালোবাসতে আমি দেখিনি। [সীরাতে
ইবনে হিসাম, ৩/২৬]
(গ) অহুদের যুদ্ধে জনৈকা আনছারিয়ার স্বামী, পুত্র ও ভাই শহীদ হলো, কিন্তু তিনি তাদের কথা ভুলে গিয়ে বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন, আল্লাহর রাসূল কেমন আছেন? যখন তিনি স্বচক্ষে আল্লাহর রাসূলকে দেখতে পেলেন
তখন আশ্বস্ত হয়ে বলে উঠলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ, আপনি বেচে থাকার পর সব বিপদই তুচ্ছ। [সীরাতে ইবেনে হিসাম,
৩/৬৩]
উম্মতের প্রত্যেক তবকায় এমন হাজারো লাখো আশিকীনে রাসূল ছিলেন যাদের কাছে তাদের
নবী ছিলেন নিজের জান-মাল, পিতামাতা, এমনকি আপন
সন্তানের চেয়ে বেশী প্রিয়। যখনই নবীপ্রেমের পরীক্ষা দেয়ার সময় এসেছে, বা পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছে উম্মতের হাজারো আশেকান জানের বাজি
লাগিয়ে সামনে এসেছেন। এমনকি এ যুগেও যখন কোন নরাধম নবীর শানে গোস্তাখি করার আস্পর্ধা
দেখায়,
নবীর শান ও মর্যাদা রক্ষার জন্য আশিকে নবী তার জান কোরবান করতেও
বিন্দুমাত্র দ্বিধা করে না। গোটা মুসলিম জাহানে যেন আগুন লেগে যায়। উম্মাহর জন্য এটি
এমনই এক নাযুক ও স্পর্শকাতর বিষয় যে, মুসলিমগণ এক্ষেত্রে একেবারে আত্মহারা হয়ে যায় এবং যে কোন পরিণতি
সম্পর্কে বেপরোয়া হয়ে যায়।
নবী প্রেমের সবচেয়ে বড় ইত্তেবায়ে সুন্নাত
নবীপ্রেমের সবচে' বড় প্রমাণ হলো তাঁর সুন্নাতের পূর্ণ ইত্তেবা। সাহাবা কেরাম যিন্দেগির প্রতিটি
ক্ষেত্রে সুন্নাতে নবীর অনুসরণে কেমন নিবেদিত ছিলেন তার তো অসংখ্য ঘটনা সীরাতে ছাহাবায়
বিদ্যমান রয়েছে। পরবর্তী যুগেও এ পবিত্র ধারা অব্যাহত ছিলো। এমনকি ধর্মের দুর্বলতার
এ যুগেও এমন অসংখ্য আশিকে রাসূল রয়েছেন যারা জীবনের প্রত্যেক ক্ষেত্রে তালাশ করে করে
সুন্নাতের উপর আমল করার জন্য সদা সচেষ্ট থাকেন। এক্ষেত্রে তারা নিন্দুকের নিন্দা ও
সমালোচকের সমালোনার কোন পরোয়া করেন না।
উম্মতের প্রত্যেক সদস্যের কর্তব্য হলো অন্তরে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
প্রতি মুহব্বত পোষণ করা এবং যথাসাধ্য তাঁর সুন্নাতের উপর আমলের চেষ্টা করা। আল্লাহ
আমাদের তাওফীক দান করুন, আমীন।
বেশী বেশী দুরূদ পাঠ করা নবীর প্রতি মুহব্বতের অন্যতম আলামত
নবীর প্রতি সাচ্চা ইশক ও মুহব্বতের আরেকটি আলামত হলো বেশী বেশী দুরূদ পাঠ করা।
এ সম্পর্কে তো স্বয়ং আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেছেন-
إِنَّ اللَّهَ وَمَلٰٓئِكَتَهُۥ يُصَلُّونَ عَلَى النَّبِىِّ ۚ يٰٓأَيُّهَا الَّذِينَ ءَامَنُوا صَلُّوا عَلَيْهِ وَسَلِّمُوا تَسْلِيمًا
নিঃসন্দেহে আল্লাহ এবং তাঁর ফিরেশতাগণ নবীর প্রতি দুরূদ প্রেরণ করেন, (সুতরাং) হে ঈমানদারগণ, তোমরাও তাঁর প্রতি দুরূদ প্রেরণ করো এবং (তার প্রতি) খুব সালাম প্রেরণ করো। (আল-আহযাব, ৩: ৫৬)
হাদীছ শরীফেও দুরূদ পাঠের এরূপ ফযীলত বর্ণিত হয়েছে, যে ব্যক্তি নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের
উপর একবার দুরূদ পাঠ করবে, আল্লাহ তা'আলা
তার উপর দশবার দুরূদ (শান্তি) প্রেরণ করবেন। ছাহাবা কেরাম এবং পরবর্তী যুগে মুহাদ্দিছীনে
কেরাম নবীর প্রতি দুরূদের কীরূপ ইহতিমাম করতেন তা তো কিতাবে হাদীছের বর্ণনাগুলো দেখলেই।
বোঝা যায়।
যুগে যুগে উম্মতে মুহম্মদী তার নবীর প্রতি এত অধিক দুরূদ পড়েছে এবং এখনো পড়ছে
যা অন্য কোন ধর্মের মানুষ কল্পনাও করতে পারে না।
اَللّٰھُمَّ
صَلِّ عَلٰی مُحَمَّدٍ وَّعَلٰٓی اٰلِ مُحَمَّدٍ کَمَا صَلَّیْتَ عَلٰٓی اِبْرَاھِیْمَ
وَعَلٰٓی اٰلِ اِبْرَاھِیْمَ اِنَّکَ حَمِیْدٌ مَّجِیْدٌ اَللّٰھُمَّ بَارِکْ عَلٰی
مُحَمَّدٍ وَّعَلٰٓی اٰلِ مُحَمَّدٍ کَمَا بَارَکْتَ عَلٰٓی اِبْرَاھِیْمَ وَعَلٰٓی
اٰلِ اِبْرَاھِیْمَ اِنَّکَ حَمِیْدٌ مَّجِیْدٌ