অযু ও তাহারাত

অযু ছাড়া ছালাত হয় না

ছালাতের প্রথম শর্ত হলো তাহারাত ও পবিত্রতা। তাহারাত ও পবিত্রতা ছাড়া ছালাত ছহী হয় না। তাহারাত ছাড়া তো ছালাতের বৈধতাই নেই।

ছালাতের জন্য আমাদেরকে প্রথমে অর্জন করতে হবে স্থুল নাজাসাত থেকে পোশাকের পবিত্রতা, দেহের পবিত্রতা ও স্থানের পবিত্রতা।

যে পোশাক পরে ছালাত পড়বে এবং যে স্থানে ছালাত পড়বে তা নাজাসাত থেকে পাক হতে হবে। তারপর অযুর মাধ্যমে অর্জন করতে হবে আত্মিক পবিত্রতা, প্রথমত প্রকাশ্য বা বাইরের দিক থেকে, তারপর বাতিন' বা ভিতরের দিক থেকে। মুছল্লির শরীরে তো কোন বাহ্যিক নাজাসাত নেই, বরং বাইতুলখালাথেকে সে নাজাসাত-মুক্ত হয়ে এসেছে। তারপর কেন আদেশ করা হচ্ছে, চারটি অঙ্গ ধোয়া ও মসেহ করার?

বোঝা গেলো, এটা শুধু স্থুল তাহারাত নয়, এটা অন্যরকম তাহারাত, যার সম্পর্ক আসলে আত্মিক পবিত্রতার সঙ্গে। বস্তুত অযু হচ্ছে দেহের ও আত্মার পবিত্রতা অর্জনের এমন এক সহজ-সুন্দর পদ্ধতি যার তুলনা পৃথিবীর অন্যকোন ধর্মের ইবাদতব্যবস্থায় নেই। অযু মানেই তো উজ্জ্বলতা।

অযুর মাধ্যমে শরীর থেকে গুনাহ ঝরে পড়ে

তাই হাদীছ শরীফে অযুর বড় বড় অনেক ফযীলত বর্ণিত হয়েছে। যেমন-

عَنْ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ "‏ مَنْ تَوَضَّأَ فَأَحْسَنَ الْوُضُوءَ خَرَجَتْ خَطَايَاهُ مِنْ جَسَدِهِ حَتَّى تَخْرُجَ مِنْ تَحْتِ أَظْفَارِهِ ‏

হযরত উছমান বিন আফফান রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি অযু করে এবং উত্তমরূপে অযু করে, তার গুনাহগুলো তার শরীর থেকে বের হয়ে যায়, এমনকি তার নখের নীচে থেকেও বের হয়ে যায়। (মুসলিম, হাদীছ নং ২৪৫)

হযরত আবু হোরায়রা (রা.)-এর হাদীছে আরো বিশদরূপে বর্ণিত হয়েছে। যে, মুমিন বান্দা যখন অযু করে এবং চেহারা ধোয় তখন চোখ দ্বারা যত গোনাহ সে করেছে ঐ সমস্ত গোনাহ পানির শেষ ফোটাটির সঙ্গে ঝরে যায়।

আর যখন সে হাত ধোয় তখন হাত দ্বারা যত গোনাহ সে করেছে ঐ সমস্ত গোনাহ পানির শেষ ফোঁটাটির সঙ্গে ঝরে যায়।

তদ্রুপ যখন সে পা ধোয় তখন যত গোনাহ সে পায়ে হেঁটে করেছে ঐ সমস্ত গোনাহ ধুয়ে মুছে যায়।

এভাবে অযুশেষে বান্দা সমস্ত গোনাহ থেকে একেবারে পাক-পবিত্র হয়ে যায়।

অযুর কারনে কিয়ামতে অযুর স্থানগুলো উজ্জল হবে

অন্য হাদীছে অযুর আরেকটি বড় ফযীলত বর্ণিত হয়েছে-

عن أبي هريرة رضي الله عنه قال إِنِّي سَمِعْتُ النَّبِيَّ صلى الله عليه وسلم يَقُولُ " إِنَّ أُمَّتِي يُدْعَوْنَ يَوْمَ الْقِيَامَةِ غُرًّا مُحَجَّلِينَ مِنْ آثَارِ الْوُضُوءِ، فَمَنِ اسْتَطَاعَ مِنْكُمْ أَنْ يُطِيلَ غُرَّتَهُ فَلْيَفْعَلْ "‏‏

হযরত আবু হোরায়রা রা. বলেন, আমি রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, নিশ্চয় আমার উম্মতকে কেয়ামতের দিন ডাকা হবে এমন অবস্থায় যে, তাদের চেহারা ও হাত-পা অযুর চিহ্ন দ্বারা উজ্জ্বল ও চমকদার হবে। সুতরাং যে নিজের উজ্জ্বলতা বাড়াতে চায় সে যেন (উত্তম অযু দ্বারা) তা বাড়িয়ে নেয়। (বুখারী হাদিসঃ ১৩৬ অযু অধ্যায়)

অন্য হাদীছমতে কেয়ামতের দিন অযুর অঙ্গগুলো শুভ্র-উজ্জ্বল হবে এবং জ্বলজ্বল করবে, আর তাতে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁর উম্মতকে চিনে নেবেন। অর্থাৎ অযুই হবে কিয়ামতের দিন তার সামনে আমাদের উম্মতি হওয়ার পরিচয়পত্র' সুবহানাল্লাহ! কত বড় ফযীলতের কথা!

অযুর ফজিলত হাছিলের জন্য সুন্নত-মুসতাহাবের ইহতিমাম করতে হবে

অযু ছাড়া ছালাত হয় না। তাই বলা হয়েছে, অযুর তাহারাত হচ্ছে। ছালাতের মিফতাহ বা চাবি। তো আমি যদি মুখমণ্ডল ও হাত-পা শুধু ধুয়ে নেই এবং মাথা মসেহ করি, যেগুলো অযুর চার ফররূপে গণ্য, তাহলে অযুর ফরয তো আদায় হয়ে যাবে এবং ছালাত ছহীহ হওয়ার শর্ত অর্জিত হয়ে যাবে, কিন্তু নিয়ত ও অনুভব-অনুভূতিহীন অযু দ্বারা সেই সব আত্মিক কল্যাণ ও ফযীলতউজ্জ্বলতা হাছিল হবে না, যার বর্ণনা হাদীছ শরীফে এসেছে।

কিন্তু যত বড় ফযীলতের কথা তত বড় আফসোসেরও কথা যে, আমরা ছালাতের প্রয়োজনে চারঅঙ্গের অযু তো করি, কিন্তু অযুর ইহতিমাম ও ফযীলতের কথা অন্তরে জাগ্রত থাকে না। আমরা খুব তাড়াহুড়া করি, যত্নের সঙ্গে অযু করি না। অযুর সুন্নত-মুসতাহাবের ইহতিমাম করি না। অনেকের তো অযুর সুন্নাত মুস্তাহাবের কথা জানাও নেই।

 

মিছওয়াকের গুরুত্ব

নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম তো অযুর সঙ্গে মিসওয়াক করার চূড়ান্তরূপে তাকীদ করেছেন। এমনকি তিনি এতদূর বলেছেন

لولا أن أشق على أمتي لأمتيم بالسواك عند كل صلاة

যদি আমার উম্মতের কষ্ট হবে, এ আশঙ্কা না হতো তাহলে তাদের আমি প্রত্যেক ছালাতের সময় মিসওয়াক করার হুকুম দিতাম। (তখন মিসওয়াক করা তাদের উপর ফরয হয়ে যেতো।) [মুসলিম, কিতাবুত তাহারাহ, ফাযলুস সিওয়াক হাদীস নং ২৫২ ]

মিসওয়াকের বহু ফযীলতও হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে। কিন্তু আমাদের মধ্যে মিসওয়াকের কী পরিমাণ ইহতিমাম আছে? আমাদের কাছে ব্রাশ আছে, পেস্ট আছে, কিন্তু কতজনের কাছে মিসওয়াক আছে? আমরা কি জানি যে, আমাদের পেয়ারা হাবীব ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম মউতের কষ্টের সময়ও মিসওয়াক করেছেন! তো হাদীছ শরীফে যে ইসবাগ ফিল ওযূ'-এর কথা এসেছে, অর্থাৎ অতি উত্তমরূপে অযু করা, যেমন ছাহাবা কেরাম অযু করে করে মানুষকে দেখাতেন, কেমন ছিলো নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অযু! মুমিন বান্দা যখন সেই রকম অযু করে তখন তার অন্তরে যোগ্যতা সৃষ্টি হয়, যাতে সে ছালাতের নূর ও সাকীনা গ্রহণ করতে পারে ।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url