আযানের হাকীকত ও মর্মবাণী


আযানের উদ্দেশ্য

আযান শুধু সময় সম্পর্কে সতর্ক করার জন্য নয় যে, ছালাতের ওয়াক্ত হয়ে গেছে, সুতরাং অযু করে মসজিদে যাও এবং জামাতে শরীক হও। এটা অবশ্যই আযানের একটি উদ্দেশ্য। কিন্তু সে জন্য তো অন্য যে কোন ব্যবস্থাই হতে পারতো, যেমন ছাহাবা কেরামের পক্ষ হতে প্রস্তাব ছিলো বিভিন্নভাবে আওয়ায দেয়ার।

কিন্তু আসমান থেকে নেমে আসা ফিরেশতা হযরত ওমর (রা.) এবং অন্য ছাহাবীকে স্বপ্নযোগে নির্দিষ্ট কিছু কালিমার আযান শিক্ষাদান করেছেন কেন? আযানের শব্দ ও কালিমাগুলো সম্পর্কে চিন্তা করলেই বোঝা যায় যে, আযানের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে বান্দাকে নামাযের হাকীকত ও মর্ম অনুধাবন করার দাওয়াত ও আহ্বান জানানো, যাতে বান্দা ছালাতের হাকীকত বুঝতে পারে এবং হাকীকতের উপলব্ধির সঙ্গে ছালাত আদায় করতে পারে।


আযানের মর্মবাণী

আযান শুরু হয়েছে আল্লাহু আকবার' এই মহান শব্দ দ্বারা। আল্লাহ সবার বড়, আল্লাহ একমাত্র বড়। বড়াই ও বড়ত্ব শুধু আল্লাহর, অন্য কারো নয়। সুতরাং ইবাদতের জন্য আমি শুধু আল্লাহর সামনেই দাঁড়াতে পারি, অন্য কারো সামনে নয়। আল্লাহর সামনেই শুধু আমার মাথা নত হতে পারে, অন্য কারো সামনে নয়।

আমার রুকু-সিজদা হবে শুধু আল্লাহর জন্য, অন্য কারো জন্য নয়। আযান শুরু হয়েছে যেমন আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দ্বারা তেমনি আযানের সমাপ্তিও হয়েছে আল্লাহর বড়ত্বের ঘোষণা দ্বারা। অর্থাৎ শুরু থেকে শেষ, পুরো আযান থেকে আমরা আল্লাহর বড়ত্বের বিশ্বাস ও উপলব্ধি অর্জন করি, তারপর আল্লাহর শাহানশাহি দরবারে দাঁড়িয়ে ছালাত আদায় করার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। তারপর কালিমায়ে শাহাদাতের মাধ্যমে তাওহীদ ও রিসালাতের ঈমান ও বিশ্বাসকে অন্তরে আবার জাগ্রত করা হয় এবং এ চেতনায় তাকে উদ্দীপ্ত করা হয় যে, ছালাত যেন হয় একমাত্র আল্লাহর জন্য। কারণ আমি তো আগেও সাক্ষ্য দিয়েছি, এখন আবার সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ছাড়া ইবাদতের উপযুক্ত কোন ইলাহ বা মাবুদ নেই।


আর শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত আমার ছালাত হতে হবে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের বাতানো সুন্নাহ ও তারীকা অনুযায়ী। কারণ এই পবিত্র কালিমা উচ্চারণ করার মাধ্যমে আমি তো আগেও সাক্ষ্য দিয়েছি, এখন আবার নতুন করে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহম্মদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আল্লাহর প্রেরিত রাসূল।

তারপর রয়েছে ছালাতের জামাতে শামিল হওয়ার উদাত্ত আহ্বান। এসো ছালাতের দিকে, এসো সফলতার দিকে। আযানের আহ্বান থেকে আমি এ চেতনা অর্জন করে ছালাতে শামিল হবো যে, ছালাতই হচ্ছে দুনিয়া ও আখেরাতের সমস্ত কামিয়াবি ও সফলতার চাবিকাঠি।


আযান শোনে মুমিন উদ্বেলিত হবে

আযানের আহবান শোনার সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃত মুমিন যারা তারা তো আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে এবং কামিয়াবি ও সফলতা অর্জনের জন্য অস্থির হয়ে মসজিদের দিকে ছুটে ছুটে আসবে! হাঁ, অতীতে একসময় এমনই দৃশ্য দেখা যেতো মুসলিম জনপদে আযানের সময়। দোকানপাট বন্ধ হয়ে যেতোক্রেতা-বিক্রেতা সবাই মসজিদের দিকে রওয়ানা হতোদেখতে দেখতে রাস্তাঘাট খালি, আর মসজিদ পূর্ণ হয়ে যেতো

যিনি বলেছেন বড় সুন্দর বলেছেন, তখন বাজার হয়ে যেতো বিরান সুনসান, আর মসজিদ হতো বিপুল সমাগমে আবাদ।

তো আযানের প্রধান উদ্দেশ্য হলো বান্দার অন্তরে ছালাতের হাকীকত ও মর্ম সম্পর্কে পূর্ণ চেতনা জাগ্রত করে দেয়া এবং আল্লাহর বড়াই ও বড়ত্বের অনুভূতি এমনভাবে পয়দা করে দেয়া যেন তার ছালাত বাহ্যিক আকার আকৃতির মধ্যেই সীমাবদ্ধ না থাকে, বরং তাতে ইবাদতের রূহ ও প্রাণ সৃষ্টি হয় এবং ছালাতের সেই সব ফায়দা ও ফযীলত হাছিল হয় যা আল্লাহ ও তার রাসূল ঘোষণা করেছেন।


কজনে আযানের মর্মবাণী গ্রহণ করার চেষ্টা করি?

আমি, আপনি, আমরা সবাই একটু বুকে হাত দিয়ে বলি তো; মসজিদের মিনার থেকে প্রতিদিন পাঁচবার মুআযযিন আযানের বাণী ও মর্মবাণী প্রচার করেন।

মুসলিম জনপদে প্রত্যেক ছালাতের সময় চারদিক থেকে আযানের যে ভাবগম্ভীর ধ্বনি ভেসে আসে, তাতে রয়েছে আল্লাহর বড়ত্বের ধ্বনি, কালিমায়ে শাহাদাতের ধ্বনি, ছালাত ও কামিয়াবির প্রতি ধাবিত হওয়ার ধ্বনি।

কিন্তু আমরা ক'জন আযানের ধ্বনি শুনে আযানের প্রতি মনোযোগী হই! দিলের কান দিয়ে আযানের মর্মবাণী গ্রহণ করার চেষ্টা করি!

আযানের মর্মবাণী যেন মুমিনের অন্তরের গভীরে প্রবেশ করে সেজন্য শুধু আযান শুনতে বলা হয়নি। মুআযযিনের অনুসরণে আযানের শব্দগুলো দোহরাতে বলা হয়েছে, যাতে প্রতিটি শব্দ ও তার হাকীকত অন্তরে বদ্ধমূল হয়।


আযানের শেষে দো‘আ কবুল হয়

হাদীছে আযানের শেষে দু'আ কবুল হওয়ার কথাও বলা হয়েছে-


 

 হযরত সাহল বিন সা'দ রা. বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন-

দুটি সময় দু'আ ফেরত দেয়া হয় না; আযানের সময়, আর (জিহাদের ময়দানে) লড়াইয়ের সময়, যখন একে অন্যকে হামলা করে। (আবু দাউদ, হাদীছ নং ২৫৪০)।

কত বড় মর্যাদা ও ফযীলতের কথা যে, দু'আর কবুলিয়াতের ক্ষেত্রে জিহাদ ও আযানকে সমতুল্য বলা হয়েছে!


আযানের দো‘আ পাঠের ফযিলত

হযরত জাবির বিন আব্দুল্লাহ রাদিয়াল্লাহু আনহুমা হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, যে ব্যক্তি আযান শোনার সময় (অর্থাৎ আযান শেষ হওয়ার পর) এই দু'আ উচ্চারণ করবে-

হে আল্লাহ, (হে) এই পরিপূর্ণ দাওয়াত এবং আসন্ন ছালাতের রাব্ব, মুহম্মদকে ওয়াছীলাহ ও ফাযীলাহ দান করুন এবং তাঁকে মাকামে মাহমূদে উপনীত করুন, যার ওয়াদা আপনি তার সঙ্গে করেছেন। আপনি তো ওয়াদাভঙ্গ করেন না।

(যে এই দুআ উচ্চারণ করবে) তার জন্য আমার শাফাআত ওয়াজিব হয়ে যাবে। (বোখারী –হাদীছ নং ৬১৪, ৪৭১৯)

[ওয়াছীলাহ, ফাযীলাহ ও মাকামে মাহমূদ, এগুলো বিশেষ বিশেষ ফযীলত ও মর্যাদার নাম, যা আমাদের নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে দান করা হয়েছে।]


বর্তমানে আযানের চেয়ে মযলুম কোন দাওয়াত আর নেই

আফসোস, আযান মনোযোগের সঙ্গে শ্রবণ করা, উত্তর দেয়া এবং আযান  শেষের দুআ পড়া, এগুলো আমরা একেবারেই ভুলে গিয়েছি।

কবি ইকবাল যেমন বলেছেন, “আযানের রসম তো রয়ে গেছে, কিন্তু সেই রূহে বিলালী আর নেই।'

আমার তো মনে হয় মুসলিম জনপদে আযানের চেয়ে মযলুম কোন দাওয়াত এবং উপেক্ষিত কোন আহ্বান আর নেই। সব দাওয়াতের এবং সব আহ্বানেরই শ্রোতা আছে, সাড়া দেয়ার মানুষ আছে, কিন্তু আযানের কোন শ্রোতা নেই। আযানের আহ্বানে অন্তর থেকে সাড়া দেয়ার যেন আজ কেউ নেই।

আল্লাহ আমাদের দিলের গাফলত দূর করে দিন এবং আমাদের অন্তর সংশোধন করে দিন। আযানের আহ্বান যেন গাফলাতের ঘুম থেকে আমাদের জাগাতে পারে এবং দিলের মধ্যে ছালাতের মুহব্বত পয়দা করতে পারে, আমীন।


আযান শোনার পর ছালাফে ছালেহীনদের অবস্থা যেমন হতো

আমার পেয়ারা ভাই, একবার আযানের মর্মবাণী উপলব্ধি করে এবং আযানের আহ্বানে সঠিকভাবে সাড়া দিয়ে ছালাতের জামাতে শামিল হও, তারপর দেখো, কত জানদার ও হাকীকতপূর্ণ হয় তোমার ছালাত। সেই ছালাত অবশ্যই আমাদের জীবনকে পবিত্র করবে এবং ফাহেশা ও অন্যায় কাজ থেকে বিরত রাখবে।

ছালাফে ছালেহীনের কারো কারো জীবনী থেকে জানা যায়, আযানের আওয়ায শোনার পর ভয়ে উৎকণ্ঠায় তাদের মুখমণ্ডল বিবর্ণ হয়ে যেতা। আল্লাহর কোন কোন বান্দা তো বেহুশ হয়ে পড়ে যেতেন।

কেন এমন হতো? কীভাবে এমন হতো? কারণ আযানের মর্মবাণী তাঁরা পূর্ণরূপে উপলব্ধি করতে পারতেন।

তাঁরা জানতেন, আযান কিসের আহবান? এখন তাদেরকে দাঁড়াতে হবে বিশ্বজগতের শাহানশাহের দরবারে! আবার এই ছালাতের হিসাব দেয়ার জন্য আখেরাতে দাঁড়াতে হবে আল্লাহ তআলার সামনে।

[সালাফে ছালেহ মানে মহান পূর্ববর্তী যিনি কোরআন ও সুন্নাহর পূর্ণ অনুসারী ছিলেন, যার পূতপবিত্র জীবন থেকে আমরা কোরআন ও সুন্নাহর জীবন্ত আদর্শ লাভ করতে পারি, বহুবচনে সালাফে ছালেহীন।]


আযানের আওয়ায শয়তান সইতে পারেনা

দাওয়াতে আযানের যে হাকীকত ও মর্মবাণী উপরে আলোচনা করা হলো, এ কারণেই শয়তান আযানের আওয়ায মোটেই বরদাশত করতে পারে না; আযান শুরু হওয়ামাত্র সে অস্থির দিশেহারা হয়ে ভাগতে থাকে, যাতে আযানের আওয়ায তার কানে না যায়, ফলে মুসলিম জনপদ থেকেই সে বের হয়ে যায়।


মুআযযিনের ফযীলত ও মর্যাদা

হাদীছ শরীফে মুআযযিনের ফযীলত সম্পর্কে বলা হয়েছে, তার আওয়ায যত দূর যায় তত দূর তাকে মাগফেরাত করা হয়। আর যত প্রাণীঅপ্রাণী তার আযানের আওয়ায় শুনেছে তারা তার আযানের উত্তর দেয় এবং তার পক্ষ্যে সাক্ষ্যদান করে এবং তার জন্য ক্ষমা ও মাগফিরাতের দুআ করে। (মুসনাদে আহমদ, ৭৬০০; আবুদাউদ, ৫১৫; ইবনে মাজাহ, ৭২৪)



 হযরত মু'আবিয়া রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে বলতে শুনেছি, মুআযিনগণ কেয়ামতের দিন সবার চেয়ে দীর্ঘ গলাবিশিষ্ট হবে। (মুসলিম, হাদীছ নং ৩৮৭)

অর্থাৎ তাকে সবার চেয়ে আলাদা করে দেখা যাবে এবং চেনা যাবে এবং মর্যাদার কারণে তিনি মাথা উঁচু করে রাখবেন। তা আল্লাহ তাআলা যেন আমাদের তাওফীক দান করেন দাওয়াতে আযানের হাকীকত কিছুটা হলেও অনুধাবন করার এবং সে অনুযায়ী ছালাতের জন্য বাহির ও ভিতরের প্রস্তুতি গ্রহণ করার, আমীন।


Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url