যাকাতে আদায় কিভাবে আলোকময় হয়?
যাকাতে নিয়তের অপরিহার্যতা
যাকাত যেহেতু আগাগোড়া একটি ইবাদত, এবং শুধু ইবাদতই নয়, বরং ঈমানের পর ইসলামের দ্বিতীয় রোকন। সুতরাং ছালাত, সিয়াম
ও হজ্বের মত এখানেও নিয়ত অপরিহার্য। নিয়ত ছাড়া যদি সমস্ত মালও কেউ দান করে দেয়, তাতে যাকাতের ফরযিয়াত আদায় হবে না। তবে পার্থক্য এই যে, ছালাত তো নিয়ত ছাড়া বাতিল হয়ে যায়, কিন্তু যাকাত আদায় না হলেও তা দান ও হেবা বলে গণ্য হবে এবং
সেটারও আলাদা ছাওয়াব হবে।
ইখলাছের সাথে যাকাত আদায়ের গুরুত্ব
তদ্রুপ নিয়ত দ্বারা ফরযিয়াত আদায় হয়ে যায়, কিন্তু নিয়তের ইখলাছ ছাড়া ছাওয়াব ও ফযীলত কিছুই হাছিল হবে
না। ইখলাছের দিক থেকে যার নিয়ত যত উত্তম হবে, ইবাদত হিসাবে তার যাকাত তত উত্তম থেকে উত্তম বলে গণ্য হবে।
প্রথমত যাকাত আদায় করতে হবে সন্তুষ্টচিত্তে এবং নিজের দুনিয়া আখেরাতের সৌভাগ্য
মনে করে। এমন যেন না হয় যে, যাকাত আদায় জরিমানা মনে করে, যেমন মুনাফিকদের অবস্থা ।
খুশিমনে যাকাত আদায় করতে হবে
যাকাত আদায় করার সময় অবশ্যই এরূপ মনোভাব থাকতে হবে যে, আমার উপর চাপিয়ে দেয়া কোন বিধান নয়, বরং আমারই কল্যাণের জন্য, আমার সম্পদের পবিত্রতার জন্য দয়াময় আল্লাহর পক্ষ হতে নাযিল
করা বিধান। বস্তুত এখানেই যাকাতের সঙ্গে দুনিয়ার অন্যান্য অর্থব্যবস্থার পার্থক্য।
মানুষ কর ও ট্যাক্স আদায় করে আইনের চাপে এবং শাস্তির ভয়ে। তাই আদর্শ থেকে আদর্শ নাগরিকের
মনেও কর এড়িয়ে যাওয়ার, কিংবা অন্তত কর লাঘব করার মানসিকতা কাজ করে থাকে।
পক্ষান্তরে মুমিনের দিলে ইচ্ছা ও আখাঙ্খা থাকে যাকাত আদায়ের সৌভাগ্য অর্জনের।
রাসূল (সা.) এর সময়ে এক বেদুঈনের যাকাত আদায়ের ঘটনা
হাদীছ শরীফে আছে, বেদুঈন পল্লীতে এক ব্যক্তির কাছে যখন উশুলকারী পৌঁছলেন তখন তিনি খুশী হয়ে বললেন, এই পশুপাল থেকে যা ইচ্ছা নিয়ে নিন। উশুলকারী নিয়মমত মাঝারি
আকারের পশু নির্বাচন করলেন, আর আদায়কারী বললেন, এই প্রথম আল্লাহ আমাকে যাকাত আদায় করার তাওফীক দান করেছেন, আর আমি এই সামান্য পরিমাণ যাকাত দেবো! না, এটা নিয়ে কী হবে, আপনি সবচেয়ে হৃষ্টপুষ্টটা নিন। কিন্তু তিনি বললেন, আমি তো নিয়ম ভঙ্গ করতে পারি না, তবে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নিকটেই অবস্থান
করছেন। আপনি তাঁর কাছে চলুন। ছাহাবী সেখানে হাযির হয়ে আরয করলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনার পক্ষ হতে যাকাত উশুলকারী আমার কাছে
এসেছেন। আল্লাহ আমাকে এই প্রথম যাকাত আদায় করার তাওফীক দান করেছেন, আমি হৃষ্টপুষ্ট পশু দিতে চাই, কিন্তু আপনার প্রেরিত ব্যক্তি বলছেন, আমার উপর শুধু মধ্যম আকারের পশু ফরয হয়েছে। নবী ছাল্লাল্লাহু
আলাইহি ওয়াসাল্লাম ছাহাবীর দিলের জাযবা দেখে সন্তুষ্ট হলেন এবং তার মালের জন্য বরকতের
দু'আ দিয়ে বললেন, তো উপর ফরয তো সেটাই যা আমার প্রেরিত ব্যক্তি বলেছে, তবে তুমি যদি উত্তমটি দিতে চাও দিতে পারো। [আবুদাউদ, হাদীছ নং ১৫৮৩ (ভাবতরজমা)]
পক্ষান্তরে হাদীছ শরীফে পরবর্তী উম্মতকে সতর্ক করে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে যে, এমন একসময় আসবে যখন মানুষ যাকাতকে আর্থিক দণ্ড মনে করে আদায়
করবে। [তিরমিযি, কিতাবুল
ফিতান,
হাদীছ নং ২২১০]
তো উভয় যাকাত কী সমান হতে পারে! একজন হায় আফসোস করছে যে আমার মাল চলে
গেলো,
আরেকজন আনন্দ প্রকাশ করছে যে, যাকাত আদায় করার সৌভাগ্য হলো। এ দু’জনের আমল কীভাবে সমান হতে পারে!
দ্বিতীয়ত যাকাত
আদায় করাকে গরীবের উপর দয়া ও অনুগ্রহ কিছুতেই যেন মনে না করা হয়, বরং যেন মনে করা হয় যে, তার কারণে এত বড় একটি ফরয এবং এমন গুরুত্বপূর্ণ একটি রোকন আদায়
করা সম্ভব হয়েছে। অন্তরের এ ভাব-অনুভূতি মুখের কথায় যেমন প্রকাশ করা উচিত তেমনি আচার-আচরণেও
প্রকাশ করা উচিত। এমন যেন না হয় যে, ঢাকঢোল পিটিয়ে ফকীর-মিসকীন' জড়ো করে সস্তায় কেনা যাকাতের শাড়ী ও গামছা-লুঙ্গি দেয়া হলো; কেউ পেলো, কেউ ভিড়ের চাপে পড়ে জান দিলো।
তৃতীয়ত ছালাতের
মধ্যে যেমন ইহসানের ভাব ও ভাবনা থাকা চাই তেমনি যাকাতের মধ্যেও সেটা থাকা চাই। অর্থাৎ
আল্লাহ তাআলা আমার যাকাত আদায় করা দেখছেন; আমার অন্তরের নিয়ত যেমন দেখছেন, তেমনি তার বান্দার প্রতি আমার আচরণও দেখছেন। হে আল্লাহ, তুমি আমার এ আমল অনুগ্রহ করে কবুল করে নাও এবং আমার মালকে পাক-পবিত্র
করে দাও।
এভাবে যদি যাকাত আদায় করা হয় তাহলে অবশ্যই তা নূরানিয়াতে পরিপূর্ণ যাকাত হবে
এবং ঐ সকল ফায়দা ও বরকত হাছিল হবে যার সুসংবাদ কোরআন-সুন্নায় এসেছে। যেমন আল্লাহ
তা'আলা ইরশাদ করেছেন
الَّذِينَ
يُنْفِقُونَ أَمْوَالَهُمْ فِي سَبِيلِ اللَّهِ ثُمَّ لَا يُتْبِعُونَ مَا
أَنْفَقُوا مَنًّا وَلَا أَذًى ۙ لَهُمْ أَجْرُهُمْ عِنْدَ رَبِّهِمْ وَلَا خَوْفٌ
عَلَيْهِمْ وَلَا هُمْ يَحْزَنُونَ
যারা আল্লাহর রাস্তায় খরচ করে, তারপর যা খরচ করেছে তার পিছনে অনুগ্রহ ফলানো, বা কষ্ট দেয়ার আচরণ না করে, তাদের প্রতিপালকের নিকট তাদের জন্য রয়েছে তাদের আজর, আর তাদের কোন ভয় নেই, আর তারা দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হবে না। (আল-বাকারাহ, ২ : ২৬২)
হাদীছ শরীফে এসেছে, ছাদাকা দ্বারা মাল কখনো কমে না। আরো এসেছে, নিশ্চয় ছাদাকা গুনাহ (এর আগুন) নিভিয়ে দেয় যেমন পানি আগুন
নিভিয়ে দেয়। [ইবনে মাজাহ, হাদীছ নং ৪২১০]
তাছাড়া হযরত আবু হোরায়রা রা. হতে বর্ণিত হাদীছে রাসূলুল্লাহ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি
ওয়াসাল্লাম বলেছেন
‘আল্লাহ তা'আলা বান্দার ছাদাকা কবুল করেন এবং তা ডান হাতে গ্রহণ করেন, তারপর তা তোমাদের কারো অনুকূলে (অর্থাৎ যাকাত আদায়কারীর অনুকূলে)
বাড়াতে থাকেন, যেমন কেউ
তার অশ্বশাবককে পরিচর্যার মাধ্যমে বড় করতে থাকে; এমনকি একটি লোকমা অহুদের মত হয়ে যায়।' [তিরমিযি, যাকাত, হাদীছ নং ৬৬২]