এতিমখানা : ইসলামি দৃষ্টিকোণ -মাওলানা যোবায়ের হোসাইন হাফি.
এতিমখানা কী?
এতিমখানা হচ্ছে, যেখানে এতিমদেরকে লালন করা হয়। বর্তমানে আমাদের সমাজে এতিমখানা নামে অনেক প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। ইসলামের ইতিহাসে এমন প্রাতিষ্ঠানিক এতিমখানার অস্তিত্ব প্রায় নেই বললেই চলে।
এতিমখানা ও ইসলামি দৃষ্টিকোণ
এতিম যদি সচ্ছল হয় তাহলে তার জন্য তার অর্থকড়ি খরচ করার অভিভাবকত্ব গ্রহণ করা একটি শরয়ী দায়িত্ব। যেন একটি মানব শিশু, একটি মুসলিম শিশু অভিভাবকের অভাবে জীবন ও জীবনের উদ্দেশ্য হারিয়ে না ফেলে।
আর যদি শিশুটি সচ্ছল না হয় তাহলে তার থাকা, খাওয়া, পোশাক তথা জীবন ধারণের অপরিহার্য উপকরণগুলোর দায়িত্ব গ্রহণ যা, ‘আসাবা বি নাফসিহী’ তথা ভাই ও চাচা থেকে শুরু করে পর্যায়ক্রমে খলিফাতুল মুসলিমীন ও
আমীরুল মুমিনীন পর্যন্ত গড়ায়।
এতিম লালন পালনের স্বাভাবিক পদ্ধতি হচ্ছে ব্যক্তিকেন্দ্রিক। এর ব্যষ্টিক কোন পদ্ধতি নেই। কারণ শরীয়ত প্রত্যেক এতিমের জন্য তার
রক্তের সম্পর্কের ওয়ারিসদের মধ্য থেকে অভিভাবক নির্ধারণ করে দিয়েছে।
শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অভিভাবকের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট এতিমের অনেক মাসআলার সম্পর্ক। যামানার ওযর দিয়ে, সমাজের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে যে দায়িত্বগুলোকে এড়িয়ে যাওয়ার কোন সুযোগ নেই।
শরীয়ত কর্তৃক নির্ধারিত অভিভাবকের সর্বশেষ সিড়িতে রয়েছে খলিফাতুল মুসলিমীন ও আমীরুল মুমিনীন বা তার পক্ষ থেকে নির্ধারিত
প্রতিনিধি। এতিমের অভিভাবকত্বের দায়িত্ব খলিফাতুল মুসলিমীন বা আমীরুল মুমিনীনের উপর আসার আগ পর্যন্ত প্রতিটি পর্বই হচ্ছে ব্যক্তিগত।
এর মাঝে সামষ্টিক রূপের কোন সম্ভাবনা নেই। এতিমের জামাত তৈরি করার কোন পদ্ধতি নেই। এতিমের ব্যবস্থাপনার জন্য আলাদা কোন শিরোনামের কোন অস্তিত্ব নেই এবং প্রয়োজনও নেই।
আর এ দায়িত্ব যখন খলিফাতুল মুসলিমীনের হাতে আসে তখন এর সামষ্টিক ও জামাতবদ্ধ একটি রূপের সম্ভাবনা সৃষ্টি হয়। কারণ একজন খলিফাতুল মুসলিমীনের আওতাধীন বিশাল মুসলিম বিশ্বের বহু এতিমের দায়িত্বই তাঁকে নিতে হতে পারে। সে ক্ষেত্রে এতিমদের পরিচর্যা পরিচালনার সুবিধার্থে জামাতবদ্ধ কোন ব্যবস্থাকে অস্বীকার করা যায় না এবং
এর সম্ভাবনাকে নাকচ করে দেওয়া যায় না।
কিন্তু এ সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও ইসলামের ইতিহাস বলে, এতিমদের জামাতবদ্ধ কোন রূপ ছিল না এবং এতিমখানা পদ্ধতির কোন অস্তিত্ব ছিল না। কেন ছিল না এর সঠিক কোন কারণ হয়তো আমরা বলতে পারব না। তবে একটা সম্ভাবনার কথা বলা যায় যে, খলিফাতুল মুসলিমীনের হাতে যেসব এতিমের লালন পালনের দায়িত্ব পড়ত সেসব এতিমকেও খলিফাতুল মুসলিমীন ব্যক্তির দায়িত্বে দিয়ে দিতেন এবং এ বাবদ খরচা দেওয়ার প্রয়োজন হলে খলিফাতুল মুসলিমীন খরচা বহন করতেন।
এতিম শরীয়তের পরিভাষায় এতিম থাকা অবস্থায় অনুভব করতে পারত না যে, সে একজন এতিম। তারা ভিন্ন প্রজাতির কিছু মানুষ। সাধারণ মানুষের পরিচয় ভিন্ন, আর তাদের পরিচয় ভিন্ন। পৃথিবীর মানুষ হচ্ছে
আশ্রয়দাতা, আর তারা হচ্ছে আশ্রিত। পৃথিবীর সকল মানুষ হচ্ছে করুণার আধার, আর তারা হচ্ছে করুণার পাত্র।
শরীয়ত যেমনিভাবে ভিক্ষুক নামের কোন কাফেলাকে স্বীকৃতি দেয় না, তেমনিভাবে এতিম নামে জামাতবদ্ধ কোন কাফেলাকেও স্বীকার করে না। এর সামষ্টিক কোন রূপ নেই। এখানে ভুল বোঝা বা ভুল বোঝানোর চেষ্টা করার কোন প্রয়োজন নেই। ভিক্ষা ছিল, ভিক্ষুক ছিল। কুরআনে হাদীসে فَقِيْر ও فقراء ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এমনিভাবে এতিম ছিল, এতিমের অভিভাবকত্ব ছিল। কুরআনে হাদীসে يتيم ও أيتام ـ ইত্যাদি শব্দ ব্যবহৃত হয়েছে। এটা কেউ অস্বীকার করতে পারবে না।
এখানে বলা হচ্ছে, এগুলোর আলাদা কোন সামষ্টিক রূপ ছিল না। জামাতবদ্ধ কোন পদ্ধতি ছিল না। ফকীরখানা ও এতিমখানা নামে আলাদা কোন আয়োজন ছিল না। খলিফাতুল মুসলিমীনের পক্ষ থেকেও ছিল না,
দানবীরদের পক্ষ থেকেও ছিল না। যেমনিভাবে বৃদ্ধদের সেবা-যত্নের সকল আয়োজন ছিল, ফযীলত ছিল, বিধান ছিল, কিন্তু বৃদ্ধাশ্রম ছিল না।
এসবই হয়েছে মূলত মূল দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার জন্য। শরীয়তের বিধানগুলো না মানার বিভিন্ন অযুহাত হিসাবেই এসকল উপসর্গের আবির্ভাব ঘটেছে।
যখন দ্বীন ও শরীয়তের তত্ত্বাবধান ছিল তখন শরীয়তের বাতলানো পদ্ধতিতেই এতিম, অসহায়, ভিক্ষুক ও বৃদ্ধদের সকল অধিকার আদায় হয়েছে। যার ফলে এতিমখানা, ভিক্ষুক নিবাস বা বৃদ্ধাশ্রম নামের কোন কিছুর অস্তিত্ব ইতিহাসে পাওয়া যায় না।
এছাড়া এতিম হওয়া কোন অপরাধ নয় যে, তারা আজীবন এতিম নাম ধারণ করেই থাকতে হবে। তাদের পরিচয়ের জন্য আর কোন বিশেষণ থাকবে না।