ঈমান, ইসলাম ও দ্বীন : পরিচিতি ও পারস্পরিক সম্পর্ক
ইসলামের পরিচয়
কোরআনুল কারীমে আল্লাহ তা'আলা ইরশাদ করেছেন
إِنَّ الدِّينَ عِندَ اللّهِ الإِسْلاَمُ
নিঃসন্দেহে আল্লাহর নিকট একমাত্র দ্বীন হচ্ছে ইসলাম। (আলে ইমরান ৩ : ১৯)
দ্বীন অর্থ এমন একটি পূর্ণাঙ্গ ও সর্বাঙ্গীন জীবনব্যবস্থা যার মাধ্যমে দুনিয়ার ক্ষণস্থায়ী জীবনকে সঠিকভাবে যাপন করে মানুষ আখেরাতের অনন্ত জীবনে অফুরন্ত সুখ-শান্তির অধিকারী হতে পারে। কিন্তু মানুষ নিজের ইচ্ছামত কোন দ্বীন বা জীবনব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারে না। যদি করে তাতে মানুষেরই বরবাদি।
বিভিন্ন যুগে বিভিন্ন জাতির জন্য বিভিন্ন নবী ও রাসূলের মাধ্যমে আল্লাহ তা'আলা আসমানী ওহীরূপে যে তরীকা ও ব্যবস্থা নাযিল করেছেন এবং যার নাম তিনি ইসলাম রেখেছেন সেটাই হলো মানুষের জন্য আল্লাহর পক্ষ হতে অনুমোদিত একমাত্র দ্বীন ও জীবনব্যবস্থা এবং দুনিয়া-আখেরাতে কামিয়াবি ও সফলতা অর্জনের একমাত্র পথ।
পূর্ববর্তী নবী ও রাসূলগণ শুধু নির্দিষ্ট কোন জাতির জন্য এবং নির্দিষ্ট কোন সময়ের জন্য প্রেরিত হতেন। সুতরাং তাদের উপর নাযিলকৃত দ্বীনও ছিলো ঐ সময় এবং ঐ জাতির জন্য নির্ধারিত। এভাবে যুগে যুগে প্রত্যেক সম্প্রদায় ও জনগোষ্ঠির কাছেই কোন না কোন নবী ও রাসূল প্রেরিত হয়েছেন। অবশেষে আল্লাহ তা'আলা হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে সর্বশেষ নবী ও রাসূলরূপে কেয়ামত পর্যন্ত সমগ্র মানবজাতির জন্য প্রেরণ করেছেন।
ইরশাদ হয়েছে - وَمَا أَرْسَلْنَاكَ إِلَّا كَافَّةً لِّلنَّاسِ بَشِيرًا وَنَذِيرًا وَلَكِنَّ أَكْثَرَ النَّاسِ لَا يَعْلَمُونَ
আমি আপনাকে সমগ্র মানবজাতির জন্যে সুসংবাদাতা ও সতর্ককারী রূপে পাঠিয়েছি; কিন্তু অধিকাংশ মানুষ তা জানে না (সাবা ৩৪: ৪৮)
তাঁর উপর নাযিলকৃত কিতাব আল কোরআন হচ্ছে আখেরী ও চিরস্থায়ী কিতাব, যা পূর্ববর্তী সমস্ত আসমানী কিতাবকে যেমন সত্য বলে সমর্থন করে তেমনি এ কথাও ঘোষণা করে যে, আল কোরআনের মাধ্যমে পূর্ববর্তী সমস্ত দ্বীন, সমস্ত কিতাব ও শরীআত রহিত করা হয়েছে।
ইরশাদ হয়েছে
الْيَوْمَ أَكْمَلْتُ لَكُمْ دِينَكُمْ وَأَتْمَمْتُ عَلَيْكُمْ نِعْمَتِي وَرَضِيتُ لَكُمُ الإِسْلاَمَ دِينًا
আজ আমি তোমাদের জন্য তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণতা দান করেছি এবং তোমাদের উপর আমার নেয়ামতকে সম্পূর্ণ করেছি; আর তোমাদের জন্য ইসলামকে একমাত্র দ্বীনরূপে অনুমোদন করেছি। (আল মাইদাহ ৫:৩) ।
মূল কথা এই হলো যে, ইসলাম নতুন কোন দ্বীন নয়, বরং হযরত আদম আ. এর মাধ্যমে যখন থেকে পৃথিবীতে মানবজীবনের শুরু তখন থেকেই মানুষের জন্য জীবনব্যবস্থারূপে দ্বীনুল ইসলামের শুরু। হযরত মুহাম্মাদ ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের মাধ্যমে দ্বীনুল ইসলাম শুধু পূর্ণাঙ্গতা ও সার্বজনীনতা লাভ করেছে এবং পূর্ববর্তী দ্বীন ও শরী'আতের কার্যকরতা রহিত হয়েছে। এখন আখেরী নবীর উপর নাযিলকৃত কিতাব ও শরীআত এবং দ্বীনুল ইসলামই হচ্ছে কেয়ামত পর্যন্ত সর্বযুগের সর্বজাতির নাজাত ও মুক্তির একমাত্র পথ।
সুতরাং প্রতিটি মানবসন্তানের প্রথম কর্তব্য হবে ইসলামের পূর্ণাঙ্গ পরিচয় জেনে নেয়া এবং বিশ্বাস ও নিষ্ঠার সঙ্গে নিজের জীবনে তা গ্রহণ করা। ইসলামের পরিচয় সম্পর্কে নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের সুবিখ্যাত হাদীছটি এই:
بني الإسلام على خمس : شهادة أن لا إله إلا الله ، وأن محمدا رسول الله ، وإقام الصلاة ، وإيتاء الزكاة ، وحج البيت ، وصوم رمضان (رواه البخاري ومسلم)
ইসলামের ভিত্তি স্থাপন করা হয়েছে পাঁচটি জিনিসের উপর। (প্রথমত) এ কথার সাক্ষ্য দেয়া যে, নেই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া এবং মুহাম্মাদ (হাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর প্রেরিত রাসূল; আর (দ্বিতীয়ত) ছালাত কায়েম করা এবং (তৃতীয়ত) যাকাত আদায় করা, এবং (চতুর্থত) হজ্ব করা এবং (পঞ্চমত) রামাযানের ছিয়াম পালন করা।
দ্বীনুল ইসলামের দু’টি ভাগ রয়েছে, যথা ঈমান ও আমাল।
ঈমান হচ্ছে দ্বীনের বিশ্বাসগত দিক, যাকে হাদীছে উল্লেখ করা হয়েছে তাওহীদ ও রিসালাতের শাহাদতরূপে। অর্থাৎ একথার সাক্ষ্য দেয়া যে, আল্লাহ ছাড়া কোন ইলাহ নেই এবং মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর প্রেরিত বান্দা ও রাসূল।
পক্ষান্তরে আ'মাল হচ্ছে দ্বীনের ব্যবহারগত দিক, যা উপরের হাদীছে ছালাত, যাকাত, হজ্ব ও ছিয়াম দ্বারা নির্দেশ করা হয়েছে।
ঈমান হচ্ছে এমন কিছু বিশ্বাসকে অন্তরে গ্রহণ করা এবং মুখে স্বীকার করা যা আল্লাহ বান্দার কাছে দাবী করেন, আর ইসলাম হচ্ছে সেই ঈমান ও বিশ্বাসের দাবী অনুযায়ী আল্লাহর পক্ষ হতে নির্ধারণকৃত আমল ও ইবাদত নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করা।
আর ঈমান ও আমল উভয়ের মিলিত বিষয়টিই হচ্ছে দ্বীন, তবে ঈমান ও আমল উভয় অংশকেও একত্রে ইসলাম বলা হয়।
দ্বীনের মূল ভিত্তি বা আসল বুনিয়াদ হচ্ছে ঈমান। ঈমান ছাড়া দ্বীনের অস্তিত্বই হতে পারে না; বাকি আমল ও ইবাদত, তথা ছালাত, যাকাত, হজ্ব ও ছিয়াম ছাড়া দ্বীনের কার্যকরতা যদিও বিরাটভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে তার পরিমান দ্বীনের অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকে। তাই হাদীছ শরীফে বলা হয়েছে, যার অন্তরে তিল পরিমাণ ঈমান থাকবে সেও জান্নাতে যাবে, আর যার অন্তরে ঈমান থাকবে না সে কখনো জান্নাতে যাবে না। পক্ষান্তরে আমলের ত্রুটি আল্লাহ আপন দয়াগুণে মাফ করে দেবেন, কিংবা ইনছাফগুণে সাজা দেবেন এবং নির্ধারিত সাজাভোগের পর ঈমানের কল্যাণে জান্নাতে দাখেল করবেন।
বঙ্গত ঈমান ও ইসলামের পরস্পর সম্পর্ককে তুলনা করা যায় মা দেহ ও প্রাণের সম্পর্কের সঙ্গে। ইসলাম যেন দেহ ও তার অঙ্গপ্রত্যয়ে আর ঈমান হলো দেহের প্রাণ।
দেহের বিভিন্ন অঙ্গ কর্তিত হলেও যান দেহে প্রাণ আছে, ততক্ষণ দেহের মূল্য আছে, কিন্তু প্রাণহীন দেহের কোন মূল্য নেই।
ঈমান ও ইসলামকে সহজে বোঝানোর জন্য হাদীছ শরীফে নবী ছাল্লালাত আলাইহি ওয়াসাল্লাম তাঁবুর সঙ্গে উপমা দিয়ে বুঝিয়েছেন। তাঁবুতে পাঁচটি খুঁটি থাকে। মাঝখানের খুঁটিটি হলো প্রধান। এর উপর তাঁবু দাঁড়িয়ে থাকা নির্ভর করে। এটা ছাড়া তাঁবুর অস্তিত্বই থাকে না। পক্ষান্তরে চারকোণের চারটি খুঁটি থাকলে তাবুটি সর্বাঙ্গ সুন্দর ও নিখুঁত থাকে, কিন্তু এই খুঁটিচারটি যদি না থাকে বা ক্ষতিগ্রস্ত হয় তাহলে তাঁবুর কার্যকরতা অনেকাংশে। বিলুপ্ত হলেও এর অস্তিত্ব বজায় থাকে।
তদ্রুপ তাওহীদ ও রিসালাতের সাক্ষ্য যে ঈমান তারই উপর ইসলামের অস্তিত্ব নির্ভর করে। বাকি ছালাত, যাকাত, হজ্ব ও ছিয়াম হচ্ছে তাঁবুর চারকোণের চারটি খুঁটির মত। এগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হলেও ঈমানের বিদ্যমানতার কারণে কোনক্রমে ইসলামের অস্তিত্ব বহাল থাকে।
বস্তুত ঈমান ও ইসলাম হচ্ছে একই সত্যের দু’টি দিকমাত্র । অর্থাৎ অন্তরের বিশ্বাসে যেটা হলো ঈমান, বাইরে দেহের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের আমলে ও আচরণে সেটাই হলো ইসলাম। ভিতরের বিশ্বাস ও বাইরের আমল, দু’টি মিলেই হলো মুকাম্মাল দ্বীন।
তত্ত্বগতভাবে দু’টি আলাদা হলেও বাস্তবে তা আলাদা নয়। যখনই ঈমানের সঙ্গে আমলের বিচ্ছেদ ঘটে ঈমানও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, ইসলামও ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
ইসলামের জন্য ঈমানের অস্তিত্ব হলো অপরিহার্য, তদ্রুপ ঈমানের সুরক্ষার জন্যও ইসলামের অপরিহার্য প্রয়োজন।
ইসলাম ছাড়া ঈমান ক্রমে দুর্বল থেকে দুর্বলতর হতে থাকে এবং একসময় আল্লাহ না করুন, ঈমান অন্তর থেকে বের হয়ে যায়।
জানাযার ছালাতে যে দু'আটি পড়া হয় তা থেকে ঈমান ও ইসলামের পরস্পর সম্পর্কের বিষয়টি বোঝা যায়-
اللهمَّ من أحييتَه منا فأحيهِ على الإسلامِ ومن توفَّيتَه منا فتوفَّهُ على الإيمانِ
“হে আল্লাহ আমাদের মধ্য হতে যাকে আপনি জীবিত রাখবেন তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখুন এবং আমাদের মধ্য হতে যাকে মৃত্যুদান করবেন তাকে ঈমানের উপর মৃত্যুদান করুন। ”
এর তাৎপর্য এটাই যে, ইসলাম হচ্ছে জীবনযাপনের আহকাম ও বিধান, যা মানুষ পূর্ণ আনুগত্যের সঙ্গে জীবিত অবস্থায় পালন করে। আর ঈমান হচ্ছে কিছু বিশ্বাসকে স্বীকার করে নেয়া যা মানুষ জীবিত অবস্থায় অন্তরে লালন করে এবং এই বিশ্বাসের উপর মৃত্যুবরণ করে।
বস্তুত ঈমানের উপর মৃত্যুবরণ করাই হলো নাজাতের শর্ত। তাই ঈমানের উপর মৃত্যুদান করার জন্য এমনকি জানাযার নামাযেও আল্লাহর কাছে দু'আ করা হয়, যাতে মাইয়েতকে সামনে রেখে যারা জানাযার ছালাতে দাড়ায় তারা তা থেকে শিক্ষা নিতে পারে।
তো ঈমান হচ্ছে বিশ্বাস, আর ইসলাম হচ্ছে সেই বিশ্বাসের দাবী অনুযায়ী আমল, আর ঈমান ও ইসলাম- উভয়ের মিলিত বিষয়টিই হচ্ছে দ্বীন। তবে অংশের নামে সমগ্রের নামকরণের সূত্রে ঈমান ও আ'মাল- উভয় অংশকেও একত্রে ইসলাম বলা হয়। কীভাবে একজন মানুষ দ্বীনুল ইসলামের গণ্ডীতে প্রবেশ করে? প্রবেশ করে অন্তরে তাওহীদ ও রিসালাতের বিশ্বাস গ্রহণ করার মাধ্যমে এবং এই বিশ্বাসের কথা মুখে স্বীকার করার মাধ্যমে। তো কালিমায়ে তাইয়েবা ও কালিমায়ে শাহাদাত হচ্ছে ঈমান গ্রহণের মাধ্যমে ইসলামে দাখেল হওয়ার একমাত্র প্রবেশপথ, যথা
لا إله إلا الله محمد رسول الله
নেই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া, মুহাম্মাদ (ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) আল্লাহর রাসূল।
أشهد أن لا إله إلا الله و أشهد أن محمد عبده ورسوله
আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, নেই কোন ইলাহ আল্লাহ ছাড়া, আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, মুহাম্মাদ তাঁর বান্দা ও তাঁর রাসূল।
উল্লেখ্য যে, কালিমা তাইয়েবা কালিমায়ে শাহাদাতের আরবী উচ্চারণ ঈমানের বিশুদ্ধতার জন্য শর্ত নয়, বরং বিষয়বস্তুর উচ্চারণই যথেষ্ট।
তদুপরি আলাদা আলাদা উভয় কালিমাহ শর্ত নয়, বরং যে কোন একটি যথেষ্ট। কারণ উভয়ের মযমূন তো অভিন্ন। তবে যেহেতু কালিমাহ ইসলামের শি'আর, বা পরিচয়বৈশিষ্ট্য, যা প্রিয় নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের যামানা থেকে ধারাবাহিকভাবে উম্মাহর মধ্যে চলে আসছে এবং তা শুধু এ জন্য নয় যে, নবী ছাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আরবীভাষী ছিলেন, সেহেতু মূল কালিমাহ-এর উচ্চারণ অবশ্যই জরুরি সুন্নাহএর অন্তর্ভুক্ত।
আরেকটি বিষয়, কালিমায়ে তাইয়েবাহর যে সমস্ত ফযীলত ও আজরছাওয়াবের কথা হাদীছ শরীফে বর্ণিত হয়েছে, যেমন মীযানের পাল্লায় সমস্ত আমলের উপর ভারী হওয়া, তা কালিমাহ-এর মূল উচ্চারণের সঙ্গেই সম্পৃক্ত, শুধু বিষয়বস্তু নিজের ভাষায় বলা দ্বারা তা কিছুতেই হাছিল হবে। না।
ঈমানই যেহেতু ইসলামের মূল ভিত্তি সেহেতু প্রথমে আমরা ঈমান সম্পর্কে বিস্তারিত জানবো। আর ঈমানের প্রথম ও প্রধান অংশ যেহেতু তাওহীদ, অর্থাৎ স্রষ্টারূপে আল্লাহর অস্তিত্ব এবং তার পরিপূর্ণ একত্বে বিশ্বাস করা সেহেতু প্রথমে আমরা এ বিষয়েই বিশদ জানা প্রয়োজন। আল্লাহই উত্তম তাওফীকদাতা।