মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)
মুসলিম জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আ.)
মূর্তি বিক্রেতা
ইব্রাহিম (আ.)এর পিতার নাম ছিল আযর। সে মূর্তি বিক্রি করতো। তাঁর পল্লীতে অনেক বড় বড় মন্দির ছিল এবং মন্দিরে অনেক মূর্তি ছিল। লোকেরা সে মূর্তিগুলোকে প্রণাম করত ।আযরও মূর্তিগুলোকে প্রণাম করত ও তাদের পূজা করত।
আযরের পুত্র
সেই আযরের পুত্রই আদি পিতা ইব্রাহিম (আ.)। তিনি তখনো ছোট ছিলেন। ইব্রাহিম দেখতেন যে, লোকেরা মূর্তিকে পূজা ও প্রণাম করে। ইব্রাহিম (আ.) জানতেন যে, মূর্তিগুলো পাথরের তৈরি তারা কথা বলতে পারে না ও কথা শুনতে পায় না। তারা কারো উপকার ও অপকার করতে পারে না। তিনি দেখতেন মূর্তির গায়ে মাছি বসে আছে অথচ তারা তাড়াতে পারে না। তিনি আরও দেখতেন ইঁদুরের দল এসে মূর্তির সামনে রক্ষিত খাবার খেয়ে ফেলেছে কিন্তু তারা প্রতিরোধ করতে পারছে না। এসব দেখে ইব্রাহিম মনে মনে ভাবলেন মানুষ মূর্তি কে সিজদা করে কেন? তিনি আপন সত্তাকে প্রশ্ন করতেন, মানুষ মূর্তির কাছে আবেদন করে কেন?
ইব্রাহিম (আ.) এর উপদেশ
ইব্রাহিম (আ.) তার পিতাকে জিজ্ঞাসা করতেন, আব্বাজান! কেন আপনি মূর্তি পূজা করেন ও তাদেরকে প্রণাম করেন এবং তাদের কাছে নিজের প্রয়োজন পেশ করেন? অথচ মূর্তিগুলো শোনে না ও কথা বলতে পারে না এবং কারো উপকার ও অপকার করতে পারে না। কেন তাদের সামনে ভোগ্যদ্রব্য রাখেন? তারা তো পানাহার করতে পারে না। আযর (এসব শুনে) ক্ষুব্ধ হত, কিন্তু বুঝার চেষ্টা করতো না। ইব্রাহিম (আ.) তার জাতীকে উপদেশ দিতেন। কিন্তু তারাও বুঝার চেষ্টা না করে তার প্রতি ক্রুদ্ধ হত। তাই তিনি (মনে মনে) স্থির করলেন উৎসবের দিন মূর্তি গুলো ভেঙ্গে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে ফেলবো । তখন তারা প্রকৃত বিষয় উপলব্ধি করতে সক্ষম হবে।
ইব্রাহিম (আ.) মূর্তি ভাঙ্গবে
উৎসবের দিন এল। লোকেরা খুব খুশি হল। শিশু-বৃদ্ধ সকলেই উৎসবে যাওয়ার জন্য বের হল। ইব্রাহিমের পিতা যাওয়ার সময় ইব্রাহিম কে জিজ্ঞাসা করলেন। তুমি কি আমাদের সঙ্গে যাবেনা? ইব্রাহিম উত্তর দিলো আমি অসুস্থ। সকলে চলে গেল। ইব্রাহিম (আ.) বাড়িতে থেকে গেল। অতঃপর ইব্রাহীম (আ.) মন্দিরে গেল এবং মূর্তিদের উদ্দেশ্য করে বলল, কি ব্যাপার! কথা বলছো না যে? আমার কথা শুনতে পাচ্ছ না? এইতো ভুগ্যদ্রব্য, খাচ্ছো না যে? পাথরের মূর্তি গুলো নীরবে দাঁড়িয়ে রইল। কিছুই বলতে পারলোনা। ইবরাহীম (আ.) বলল, কি হল, কথা বলছ না যে? কিন্তু তারা পূর্বের ন্যায় চুপ মেরে রইল। কোন কথা বলল না । তখন ইব্রাহিম (আ.) ভীষণ ক্রুদ্ধ হয়ে কুঠার হাতে নিল এবং মূর্তিগুলো ভেঙ্গে গুড়িয়ে দিল। আর বড় মূর্তিটিকে অক্ষত রেখে তার গলায় কুঠার ঝুলিয়ে দিল।
এই অপকর্মকে করেছে?
লোকেরা উৎসব থেকে ফিরে এসে মন্দিরে প্রবেশ করল এবং উৎসবের দিন হিসাবে মূর্তিকে প্রণাম করতে চাইলো। কিন্তু তারা ভেতরে ঢুকে অবাক হতবুদ্ধি হল এবং ক্ষিপ্ত ও অনুতপ্ত হয়ে বললঃ আমাদের উপাস্যদের সাথে এই অসদাচারণ অসদাচরণ কে করল? কেউ কেউ বলল আমরা ইব্রাহিম নামের এক যুবককে তাদের সমালোচনা করতে শুনেছি। অতঃপর তারা জিজ্ঞাসা করল, হে ইব্রাহিম! আমাদের উপাস্যদের সঙ্গে এরূপ আচরণ কি তুমি করেছো? ইব্রাহিম উত্তর দিলো আমি না। বরং তাদের এই বড়টি তা করেছে। যদি সে কথা বলতে পারে তাহলে তাকে জিজ্ঞাসা করে দেখ। কিন্তু লোকেরা জানতো পাথরের মূর্তি কথা বলতে ও কথা শুনতে পারে না। তারা এটাও জানত যে বড় মূর্তিটিও পাথরের তৈরি। সে নড়াচড়া করতে ও মূর্তিগুলোকে ভাঙতে পারে না। ফলে তারা ইব্রাহিম কে বলল, তুমি তো জানো যে মূর্তি কথা বলতে পারেনা। তখন ইব্রাহীম বললেন মূর্তি যখন কারো উপকার বা অপকার করতে পারেনা তাহলে তোমরা তার কাছে প্রার্থনা করো কি করে? তোমাদের কি কোন জ্ঞান বুদ্ধি নেই? তখন তারা লজ্জায় চুপ মেরে গেলো।
শীতল অগ্নি
(বিক্ষুব্ধ) জনতা পরামর্শে মিলিত হয়ে বলল, আমাদের এখন কী করণীয়? ইব্রাহিম মূর্তি ভেঙ্গে আমাদের উপাস্যদের অপমান করেছে। (উত্তেজিত) জনতা জানতে চাইল ইব্রাহিমের কি শাস্তি হবে? তার কি প্রতিদান হবে? জবাব এল, তাকে জ্বালিয়ে দিয়ে তোমাদের পক্ষ থেকে প্রতিশোধ গ্রহণ করো। অবশেষে তাই করা হল। আগুন জ্বালিয়ে তাতে ইব্রাহিমকে নিক্ষেপ করা হল। কিন্তু আল্লাহ তা‘আলা তার সাহায্যের জন্য আগুনকে নির্দেশ করে বললেন; হে আগুন! ইব্রাহিমের প্রতি শীতল ও নিরাপদ হয়ে যাও। তাই হল, আগুন ইব্রাহিম এর জন্য শীতল ও নিরাপদ হয়ে গেল। ইব্রাহিমকে আগুনের মধ্যে আরামে ও আনন্দে দেখে লোকেরা হতবাক ও হতভম্ব হল।
কে আমার প্রতিপালক?
এক রাত্রে ইব্রাহিম এক উজ্জ্বল তারকা দেখে ভাবলেন, ইনি আমাদের প্রতিপালক। কিন্তু যখন তারকাটি অদৃশ্য হল, তখন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন না, আমার প্রতিপালক নয়। তারপর যখন চন্দ্র দেখতে পেলেন তখন তিনি ভাবলেন ইনিই আমার প্রতিপালক হবেন কিন্তু যখন চন্দ্র অদৃশ্য হল তখন তিনি সিদ্ধান্তে পৌঁছলেন যে, এ আমার প্রতিপালক নয় । ভোরে যখন সূর্য উদিত হল তখন তিনি ভাবলেন ইনি হবেন আমার প্রতিপালক কারণ ইনি সবার চেয়ে বড়। কিন্তু সন্ধ্যায় যখন সূর্য অস্তমিত হল তখন তিনি এই সিদ্ধান্তে পৌঁছালেন এ আমার প্রতিপ্রালক হতে পারে না বরং এগুলোর সৃষ্টিকর্তা আল্লাহই আমার প্রতিপালক। কেননা আল্লাহ চিরঞ্জীব তার মৃত্যু নেই। আল্লাহ চিরস্থায়ী। তিনি কখনো অদৃশ্য হতে পারে না। কিন্তু তারকা এমন দুর্বল যে প্রভাত তাকে কাবু করে ফেলে। চন্দ্র এমন দুর্বল যে সূর্যের আলো তাকে নিস্প্রভ করে ফেলে। সূর্য এমন দুর্বল যে রাতের অন্ধকার ও মেঘের ছায়া তাকে দীপ্তিহীন করে দেয়। অতএব চন্দ্র, সূর্য ও নক্ষত্র কেউ আমাকে সাহায্য করতে পারবে না। কেননা তারা সকলেই দুর্বল। একমাত্র আল্লাহ আমাকে সাহায্য করবেন। কেননা তিনি চিরস্থায়ী ও চিরঞ্জীব চিরস্থায়ী ও চির শক্তিমান।
আল্লাহ্ আমার প্রতিপালক
ইব্রাহীম বুঝতে পারলেন যে, আল্লাহই তাঁর প্রতিপালক। কেননা তিনি চিরঞ্জীব, মৃত্যু বরণ করে না। তিনি চিরস্থায়ী, অদৃশ্য হননা। তিনি চিরশক্তিমান, কেউ তাঁকে পরাজিত করতে পারে না। ইব্রাহিম (আ.) আরো বুঝলেন যে, চন্দ্র, সূর্য এবং বিশ্ব জাহানের প্রতিপালক আল্লাহ্। অতঃপর আল্লাহ্ তা‘আলা ইব্রাহিম (আ.) কে নবী ও বন্ধু মনোনীত করলেন এবং কওমকে মূর্তিপূজা থেকে নিষেধ করে এক আল্লাহর এক আল্লাহর ইবাদত করার আদেশ করলেন।
ইব্রাহিম (আ.) এর দা‘ওয়াত
ইব্রাহিম (আ.) স্বজাতিকে আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিলেন এবং মূর্তি পূজা থেকে নিষেধ করে বললেন,তোমরা কিসের পূজা কর? তারা বলল আমরা কিছু দেব দেবী পূজা করি।ইব্রাহিম আলাই সালাম আবার জিজ্ঞেস করলেন তারা কি তোমাদের ডাকে সাড়া দেয়? কিংবা তোমাদের কোন উপকার বা অপকার করে? তারা বলল, ওসব কিছু না বরং আমরা আমাদের পূর্বপুরুষদেরকে এরূপ করতে দেখেছি। তখন ইব্রাহিম বললেন তবে আমি এসবের পূজা করবো না বরং আমি এসবের বিরোধী । আমি সমগ্র বিশ্বজগতের প্রতিপালকের ইবাদত করব। যে আমাকে সৃষ্টি করেছেন। যিনি আমার পানাহারের ব্যবস্থা করেন এবং যার হাতে আমার হায়াত-মউত। তিনি আমাকে সঠিক পথ দেখাবেন এবং রোগ হলে আরোগ্য দান করবেন। কিন্তু মূর্তি সৃষ্টি করতে পারে না। কারো পানাহার যোগাতে পারে না। কারো অসুস্থতায় সুস্থতা দান করতে পারে না। কারো জীবন মরণ তার হাতে নেই।
রাজার দরবারে
তখন সে দেশে এক প্রভাবশালী রাজা ছিল। লোকেরা তাকে সিজ্দা করত। রাজা শুনতে পেল যে, ইব্রাহিম (আ.) আল্লাহ ছাড়া কাউকে সিজদা করে না। তখন রাজা খুব ক্রুধান্বিত হয়ে ইব্রাহিম (আ.) কে রাজ দরবারে ডেকে পাঠালেন। ইব্রাহিম (আ.) (নির্ভয়ে) হাজির হলেন। কারণ তিনি শুধু আল্লাহকে ভয় করেন। রাজা জিজ্ঞেসে করল; হে ইব্রাহিম! তোমার প্রতিপালক কে? ইব্রাহিম (আ.) উত্তর দিলেন, যিনি জীবন-মৃত্যুর মালিক। রাজা বলল; আমিওতো জীবন-মৃত্যুর মালিক।তখন রাজা একজন লোককে ডেকে এনে হত্যা করল এবং আরেকজন লোককে ডেকে এনে মুক্তি দিয়ে বলল, (দেখলে তো) আমি জীবন-মৃত্যুর মালিক। রাজাটি ছিল বোকা। আর মুশরিকরা এমনই হয়ে থাকে।ইব্রাহিম (আ.) চাইলেন রাজা ও প্রজারা বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করুক। তাই তিনি রাজাকে উদ্যেশ্য করে বললেন, আমার আল্লাহতো পূর্ব দিক থেকে সূর্য উদিত করেন। (যদি পার) তাহলে তুমি পশ্চিম দিক থেকে উদিত করতো দেখি? তখন রাজা হতভম্ব হল এবং লজ্জিত হয়ে চুপ মেরে গেল এবং কোন উত্তর খুঁজে পেলনা।
পিতার প্রতি দাওয়াত
ইব্রাহিম পিতা কে দাওয়াত দেওয়ার উদ্দেশ্যে বললেন; আব্বাজান! আপনি এমন জিনিসের ইবাদত করেন কেন? যা শুনে না, দেখে না, এবং কারো উপকার ও অপকার করতে পারে না। হে আব্বা! আপনি শয়তানের ইবাদত করবেন না; বরং অতি দয়াময় আল্লাহর ইবাদত করুন। তখন ইব্রাহিম (আ.) এর পিতা ক্রুদ্ধ হয়ে বলল, আমাকে আমার পথে আমাকে চলতে দাও, নচেৎ আমি তোমাকে প্রহার করব। ইব্রাহিম (আ.) অত্যন্ত সহনশীল ছিলেন। তিনি বললেন, আপনার উপর শান্তি বর্ষিত হোক। আমি এখান থেকে চলে যাব এবং আপন মনে আমার প্রভুকে ডাকবো। ইব্রাহিম তার পিতার জন্য খুব আক্ষেপ করলেন এবং অনত্র গিয়ে আল্লাহর ইবাদত করার ও আল্লাহর দিকে মানুষকে ডাকার মনস্থ করলেন।
অসমাপ্ত