সূরা আল বাকারা; নামকরণ, নাযিলের সময়-কাল, নাযিলের উপলক্ষ

সূরা আল বাকারা; নামকরণ, নাযিলের সময়-কাল, নাযিলের উপলক্ষ

সূরা আল বাকারা
আয়াত ২৮৬
রুকু- ৪০

নামকরণ

সূরাটির নাম ‘বাকারা’ এজন্য রাখা হয়েছে যে, এতে ‘বাকারা (গাভী) সংশ্লিষ্ট একটি ঘটনা উল্লেখিত আছে। কুরআন মাজীদের প্রায় প্রতিটি সূরাতেই অনেক সংখ্যক বিষয় আলোচিত হয়েছে। সকল বিষয়কে অন্তর্ভুক্ত করে সূরার শিরোনাম গ্রহণ করা সম্ভব নয়। এজন্য রাসূলুল্লাহ (স.) আল্লাহর নির্দেশে সূরাগুলোর বিষয় ভিত্তিক শিরোনামের পরিবর্তে শুধুমাত্র পরিচিতির স্বার্থে বা চিহ্ন স্বরূপ নামকরণ করেছেন।এর দ্বারা উদ্দেশ্য হলো এটা সেই সূরা যাতে ‘বাকারা’ তথা গাভীর উল্লেখ আছে।

নাযিলের সময়-কাল

এ সূরার অধিকাংশই মহানবী (সা.) এর মাদানী জীবনের প্রথম দিকে নাযিল হয়েছে।সূরার শেষের দিকের কিছু আয়াত হিজরতের পূর্বে মক্কায় নাযিল হয়েছে।বিষয়বস্তুর মিল থাকার কারনেই বিভিন্ন পর্যায়ে নাযিলকৃত অংশসমূহকে একই সূরার অধীনে সন্নিবেশিত করা হয়েছে।  

নাযিলের উপলক্ষ

এ সূরাটির তাৎপর্য অনুধাবনের জন্য নাযিলের সময়কালীন সার্বিক অবস্থা সম্পর্কে সম্যক ধারণা থাকা দরকার।
এক: হিযরতের পূর্বে কুরআন মাজীদের নাযিলকৃত আয়াতসমূহে সম্মোধন করা হয়েছিল মুশরিক তথা মুর্তিপূজারীদেরকে এবং সেই আলোকেই আলোচনা অব্যাহত ছিল।কিন্তু হিজরত পরবর্তী পর্যায়ে মুসলমানদেরকে ইয়াহুদীদের মুখোমুখি হতে হয়েছে। ইয়াহুদীরা হযরত মূসা (আ.) কতৃক প্রচারিত ইসলাম থেকে বহু দূরে সরে গিয়েছিল।তারা তাওরাতের শিক্ষাকে ভূলে গিয়ে নিজেদের মনগড়া নিয়ম-নীতি অনুসরণ করেই চলছিল।তাদের মধ্যে সর্বস্তরেই নানাবিধ বিকৃতি এসে গিয়েছিল। তাদের সমাজ নেতা, ধর্মীয় নেতা, আম জনসাধারণ কেউই এ বিকৃতি থেকে নিরাপদ ছিলনা।যেহেতু সকল নবীর প্রচারিত জীবনব্যবস্থাই ছিল ইসলাম, সেহেতু মুসা (আ.) এর অনুসারী হিসেবে তারাও প্রথমত মুসলিম ছিল; কিন্তু পরবর্তীতে নিজেদের মুসলিম না বলে ইয়াহুদী বলা শুরু করেছিল।
অতপর রাসূলুল্লাহ্ (সা.) যখন মদীনায় হিজরত করে আল্লাহর নির্দেশে ইয়াহুদীদেরকে ইসলামের দাওয়াত দিলেন, তখন তারা বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। সূরার প্রথম দিকের ১৫/১৬ রুকু পর্যন্ত ধারাবাহিকভাবে ইয়াহুদীদের সমালোচনা ও তাদেরকে ইসলাম গ্রহণের দাওয়াতের বিষয়ই আলোচিত হয়েছে।  
দুই: হিজরতের পূর্বে দীনী তাবলীগ এবং ইসলাম গ্রহণকারীদের ব্যক্তি পর্যায়ের শিক্ষা এবং চারিত্রিক সংশোধনের পর্যায় পর্যন্তই ইসলাম সীমাবদ্ধ ছিল; কিন্তু হিজরতের পর ইসলামী সমাজ ও রাষ্ট্র গঠন, আর্থ-সামাজিক নিয়ন নীতি, আইন-কানুন প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি বিষয়ক আয়াতও অবতীর্ণ হচ্ছিল। এ সূরার শেষ দিকের ২৩টি রুকূতে এ সর্ম্পকিত আলোচনাই অধিক।
তিন: মক্কার কাফেরদের আয়ত্তাধীন এলকাতেই ইসলামের সূচনা হয়েছিল; যারা মুসলমান হচ্ছিল তারা নির্বিবাদে কাফেরদের অমানুসিক অত্যাচার-নির্যাতন সয়ে যাচ্ছিল। কোন প্রকার দ্বন্দ্বে জড়িয়ে পড়ার সুযোগও তাদের ছিল না, আর আল্লাহর নির্দেশও ছিলনা।কিন্তু যখনই মদীনায় হিজরত করে মুসলমানগণ একটি ঐক্যজোটে পরিণত হলো, একটি রাষ্ট্রের রূপরেখা সুস্পষ্টরূপে দেখা দিল, মুসলমানদের অবস্থার পরিবর্তন হতে লাগলো, তখনই কাফেরদের পক্ষ থেকে মুসলমানদেরকে নিমূল করার চেষ্টাও জোরদার হতে লাগল।এ বিশাল শক্তির সঙ্গে লিপ্ত হয়ে মুসলমানদের অস্তিত্ব রক্ষা করা সম্ভব ছিলো না, যদি না আল্লাহ তায়ালা মুসলমানদেরকে এ সূরার নিন্মোক্ত পাঁচটি বিষয়ে নির্দেশ না দিতেনঃ
ক) পূর্ণ শক্তি ও উদ্যম প্রয়োগে নিজেদের জীবনব্যবস্থার নিয়ম-নীতিকে প্রচার করে যতো বেশী সম্ভব লোককে ইসলাম গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা।
খ) বিরোদ্ধ কাফির শক্তির ভ্রান্তি ও ভ্রষ্টতা সম্পর্কে অকাট্য যুক্তি-প্রমাণ পেশ করে তাকে পরিত্যাজ্য প্রমাণ করা।
গ) নিরাশ্রয়, দরিদ্র ও প্রবাসী হওয়ায় মুসলমানগণ যে নিরাপত্তাহীন ও সংকটজনক পরিস্থিতির মুখোমুখি হয়েছিল তাতে  ধৈর্য, ত্যাগ ও নিষ্ঠার মাধ্যমে পরিস্থিতির মোকাবেলা করা।
ঘ) ক্রমাগ্রসরমান এ দ্বীনি দাওয়াতকে থামিয়ে দেয়া বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টিকারী বিরোধীদের শক্তি, জনবল, সাজ-সরঞ্জাম প্রভৃতির প্রতি কোন প্রকার তোয়াক্কা না করে তাদের মোকাবেলার জন্য সর্বদা প্রস্তুত থাকা।
ঙ) মুসলমানদের মনে এতটুকু  শক্তি-সাহসের সঞ্চার করে দেয়া যে, যদি পৌত্তলিক আরবগণ এ সত্য দীন তথা ইসলামী জীবনব্যবস্থা গ্রহণ না করে, তাহলে তাদের জাহেলিয়াতের বিপর্যয়কর জীবনব্যবস্থাকে প্রয়োজনে শক্তি প্রয়োগে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে।
চার:  দাওয়াতে ইসলামীর এ মাদানী পর্যায়েই মুনাফিক শ্রেণির আত্মপ্রকাশ ঘটতে লাগলো। অবশ্য মক্কাতেও মুনাফিকদের একটি শ্রেণীর আত্মপ্রকাশ ঘটেছিল। এ শ্রেণীর মুনাফিকরা ইসলামকে সত্য ও কল্যাণময় জীবন বিধান হিসেবে মানতো। ইসলামের সত্যতা তারা মুখে ঘোষণাও  করতো; কিন্তু ইসলাম গ্রহণ করে সমাজচ্যুত হতে তারা রাজী ছিল না।
মদীনাতে মুনাফিকদের এ শ্রেণী তো ছিলই, অধিকন্তু সেখানে আরো চার শ্রেণীর মুনাফিকের প্রকাশ ঘটেছিলঃ
(১) একদল আসলেই কাফির ও ইসলামের দুশমন ছিল; কিন্তু ইসলামের ক্ষতি করার মতলব নিয়ে মুসলমানদের অন্তর্ভুক্ত হয়েছিল।
(২) দ্বিতীয় একদল মুনাফিক ইসলামী সমাজের অভ্যন্তরে মুসলমান পরিবেষ্টিত ছিল। তারা মুসলমান পরিচয়ে  ভেতরে ভেতরে কাফিরদের সাথে সম্পর্ক রাখার মধ্যে নিজেদের কল্যাণ মনে করত।
(৩) তৃতীয় একদল ছিল যারা ইসলামের সত্যতা সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিসন্দেহ ছিল না। তাদের গোত্র বা বংশের লোকদের সাথে তারা প্রকাশ্যে মুসলমান হয়েছিল।
(৪) চতুর্থ আর একদল মুনাফিক ইসলাম যে সত্য ও সনাতন জীবনব্যবস্থা তা বুঝতে সক্ষম হয়েছিল এবং প্রকাশ্যে ইসলাম গ্রহণও করেছিল; কিন্তু জাহেলী সমাজের বল্গাহীন জীবনাচার ত্যাগ করে ইসলামী বিধি-বিধান পালন করতে চাইতো না।
এ শ্রেণীর মুনাফিকদের প্রকাশলগ্নেই সূরা আল বাকারা নাযিল হয়েছিল। তাই সূরার বিভিন্ন আয়াতে মুনাফিকদের ব্যপারে আল্লাহ তায়ালা সংক্ষিপ্ত ইঙ্গিত করেছেন।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url