আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী আসহামের নামে লেখা রাসূলুল্লাহ (সা.) এর চিঠি
আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী আসহামের নামে লেখা চিঠি
আবিসিনিয়া-অধিপতি নাজ্জাশীর নামে রাসুল (সা.) এর চিঠি সপ্তম হিজরীতে হযরত আমর বিন উমাইয়া যামরী বহন করে নিয়ে যান । চিঠি সহ নাজ্জাশীর দরবারে উপস্থিত হয়ে তিনি এভাবে বক্তব্য উপস্থাপন করেন।
জাঁহাপনা! আমার উপরে সত্য পৌছিয়ে দেয়া এবং আপনার উপর তা শুনার ও গ্রহণ করা দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। বিগত দিনগুলোতে আপনি আমাদের প্রতি যে সহমর্মিতা ও দয়া প্রদর্শন করেছেন তাতে আমরা আপনাকে আমাদের এই একজন হিসেবে মনে করি । আপনার প্রতি আমাদের যে গভীর আস্থা রয়েছে তাতে আপনাকে আমাদের বাইরের বলে আমরা ভাবতে পারিনা। আমরা আমাদের কাঙ্খিত সহযোগীতা আপনার পক্ষ থেকে লাভ করেছি এবং আপনার পক্ষ থেকে যেসব অনীষ্টের আশংকা ছিল তা থেকে আপনি আমাদের নিরাপদ রেখেছেন ।
আমাদের পক্ষ থেকে আপনার নিকট একটি নিশ্চিত দৃষ্টান্ত হচ্ছে হযরত আদমের সৃষ্টি। যে রহস্যময় আল্লাহর কুদরতি হাত হযরত আদম আলাই সালাম কে পিতা-মাতা বিহীন মাটি থেকে সৃষ্টি করেছেন, তিনি হযরত ঈসা (আ.)কে পিতাবিহীন মাতৃগর্ভে জন্মদান করেছেন । আল্লাহর নিকট ঈসা (আ.)-এর দৃষ্টান্ত হচ্ছে আদম (আ.) এর মতো। আদম কে তিনি সৃষ্টি করেছেন, তারপর তিনি নির্দেশ করেছেন এবং আদম সৃষ্টি হয়েছেন।
আমাদের এবং আপনাদের মধ্যে ইঞ্জিল (বাইবেল) হচ্ছে এমনই একটি সাক্ষ্য যা কোনদিন প্রত্যাখ্যাত হতে পারে না । আর এ হচ্ছে এমনই এক মিমাংসাকারী যার দ্বারা জুলুম হতে পারে না।তাই নবী (সা.) এর আনুগত্য ও অনুসরণে কল্যাণ নেমে আসবে। তাতে মর্যাদাও লাভ হবে।
হে রাজন! আপনি যদি মোহাম্মদে (সা.) অনুসরণ না করেন তবে এই নিরক্ষর নবীকে প্রত্যাখ্যান করার দরুন আপনাকে ঠিক সেরূপ দুর্ভোগ ও পাপের অধিকারী হতে হবে যেমনটি হযরত ঈসা (আ.) কে অস্বীকার করার কারনে ইহুদিদের হয়েছিল।
আমারই মতো আরো কয়েকজন বার্তাবাহক রাসূলে আকরাম (সা.) এর পক্ষ থেকে অপর কয়েকজন বাদশাহর দরবারে ইসলামের দাওয়াত নিয়ে রওয়ানা হয়েছেন কিন্তু বিশ্বনবী যে বিরাট আশা-আকাঙ্ক্ষা আপনার প্রতি পোষণ করেন, অন্যদের বেলায় তিনি ততটুকু আশাবাদী নন। আর তাদের সম্পর্কে তিনি যে আশঙ্কা পোষণ করেন আপনার ব্যাপারে তার মনে সেসব আশঙ্কাও নেই । আপনার ব্যবহারে তিনি নিশ্চিত যে, আপনি আপনার আল্লাহর প্রতি অতীতে যে আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন তা অব্যাহত রাখবেন এবং ভবিষ্যতের বিরাট পুণ্য ও পারিশ্রমিক লাভে ধন্য হবেন।
আসমাহা গভীর মনোযোগ সহকারে এ বক্তব্য শুনেন। তারপর বলেন,
“হে আমর ! আল্লাহর নামে সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর সে নির্বাচিত ও সম্মানিত পয়গম্বর যাঁর শুভ আগমনের প্রতীক্ষায় আহলে কিতাব সম্প্রদায়ের লোকজনেরা দিন গুনছে ! নিঃসন্দেহে হযরত মুসা (আ.) যেরূপ গর্দভারোহী ঈসা (আ.) নবীর শুভাগমনের সুসমাচার প্রচার করেছিলেন, তেমনি ঈছা (আ.)ও উষ্টারোহী এর সুসমাচার প্রচার করেছেন করে গেছেন ।এ দুইয়ের মধ্যে চুল পরিমানও পার্থক্য নেই । এ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ দর্শন ও সুসমাচার আমার কাছে সমার্থক। কিন্তু আবিসিনিয়া বাসীদের মধ্যে আমার সমর্থক সংখ্যা খুবই অল্প । আপনাদের কাছে আমার অনুরোধ, আমাকে একটু সময় দিন যাতে আমি আমার সম্প্রদায়ের মধ্যে আমার কিছু সমর্থক সৃষ্টি করতে এবং তাদের মন প্রস্তুত করতে (জনমত সৃষ্টি করতে) সক্ষম হই।”
তারপর তিনি আমর ইবনে উমাইয়া আর হাত থেকে এসে এই চিঠিখানা গ্রহণ করলেন। উক্ত চিঠির সম্মানার্থে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন এবং পবিত্র চিঠিখানা সসম্মানে চক্ষুদ্বয়ে লাগালেন এবং দোভাষীর মাধ্যমে চিঠিখানা পড়িয়ে শুনলেন।
“বিসমিল্লাহির রহমানির রহিম। পরম দয়ালু আল্লাহর নামে মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ এর পক্ষ থেকে হাবশা অধিপতি আসহামের প্রতি-
‘আপনি শান্তিতে থাকুন! সেই আল্লাহর প্রশংসা আপনার কাছে লিখছি যিনি ব্যতীত অন্য কোন উপাস্য নেই। যিনি রাজাধিরাজ । পবিত্র, শান্তির আধার, নিরাপত্তা বিধানকারী এবং নিরাপদে রাখার মালিক।আমি স্বীকার করছি মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.) রুহুল্লাহ এবং কালিমাতুল্লাহ -যাঁকে সেই পবিত্রাত্মা কুমারী মরিয়মের গরমে গর্ভে নিক্ষেপ করা হয়- যিনি ছিলেন পাপমুক্ত। আল্লাহ তা‘আলা তাকে (ঈসা আ. কে) তাঁর আপন আত্মা ও ফুঁক থেকে ঠিক তেমনি ভাবে সৃষ্টি করেছেন, যেমনি তিনি আদম আলাই সাল্লাম কে স্বহস্তে সৃষ্টি করেছেন।আমি আপনাকে সেই একক অদ্বিতীয় উপাস্যের দিকে আপনাকে দাওয়াত দিচ্ছি। আপনি আমার আনুগত্য স্বীকার করুন, কেননা আমি আল্লাহ প্রেরিত রাসূল। আমি আপনাকে এবং আপনার বাহিনীগুলোকে মহান আল্লাহর দিকে দাওয়াত দিচ্ছি। আল্লাহর পয়গাম অত্যন্ত নিষ্ঠা সহকারে পৌঁছে দেয়ার ব্যাপারে আমি আপনাদের পূর্ণ মঙ্গল কামনা করছি। আমার এ সহানুভূতিপূর্ণ দাওয়াতে সাড়া দিয়েই হবে আপনার কাজ ।আমি আপনার প্রজাবর্গকেও এ দাওয়াত দিচ্ছি । সত্য পথের পথিকদের প্রতি সালাম ও করুণা বর্ষিত হোক।(সীল মোহর)
মুহাম্মাদুর রাসূলুল্লাহ
আবিসিনিয়ার বাদশা নাজ্জাশী-যার নাম আসহাম বিন আবজুর- তিনি ছিলেন রোমান ক্যাথলিকদের বিপরীতে ত্রিত্ববাদের বিরোধী, এর বিপরীতে তিনি এক আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন। খ্রিস্টানদের অপর গ্রুপটি ছিল ত্রিত্ববাদ এর সমর্থক এবং রোমান গির্জা ও রোম সম্রাটের সমর্থনপুষ্ট। রোম সম্রাটের দরবারে কিছু সংখ্যক মূর্তিপূজারী ও থাকতো। এক আত্মা ও ত্রি-আত্মার সমর্থকদের মধ্যে রোম সম্রাটের দরবারে এবং সভা-সমাবেশে প্রায় বাহাস তর্ক-বিতর্ক লেগেই থাকত। এ ধরনের বাদানুবাদ ও সাম্প্রদায়িক তিক্ততা তখনকার সমগ্র খ্রিস্ট জগতের বিরাজ করত ।
নাজ্জাশী যেহেতু ত্রিত্ববাদের বিপরীতে এক আত্মায় বিশ্বাসী ছিলেন, তাই ইসলামের একত্ববাদের দাওয়াত
তাকে প্রভাবান্বিত করে। উপরন্তু বিগত নয়-দশ বছর ধরে তিনি আবিসিনিয়ায় হিজরতকারী মুসলমানদের চাল-চলন ও চরিত্র দেখে আসছিলেন যে, তারা কতো সৎ ও আল্লাহ ভীরু। তাই তার নিশ্চিত বিশ্বাস জন্মে যে, এরা যে রাসুলের অনুসারী নিশ্চয়ই তিনি সত্য নবী।
মনে হয় এই চিঠিখানা বাদশাহের আম দরবারে তাঁর নিকট পেশ করা হয়নি এবং নাজ্জাশীর কোন খাস মজলিসে এই চিঠিখানা হস্তান্তর করা হয়।
কেননা নাজ্জাশী তার ইসলাম গ্রহণের কথা তার দরবারীদের এবং প্রজা সাধারণের নিকট গোপন রেখেছিলেন।সোহাইলী ‘রওযুল আনফ’ গ্রন্থে বর্ণনা করেন যে, নাজ্জাশীর ইসলাম গ্রহণের গুজব রাজ্য জোড়া ছড়িয়ে গেলে হাবশাবাসীগণ বিদ্রোহ করতে উদ্যত হয় এবং তারা নাজ্জাশীর বিরুদ্ধে শোভাযাত্রা, বিক্ষোভ প্রদর্শন করতে থাকে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, নাজ্জাশী রাসুল (সা.) এর পত্র বাহক হযরত জাফর (রাযি.) কে ডেকে পাঠিয়ে বললেন, আমি আপনাদের জন্য একটি নৌবহর তৈরি করে রেখেছি । পরিস্থিতি অবনতির দিকে গেলে মুহাজিরদের এ নৌ বহরে সওয়ার করে দেবেন। আমি যদি পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে সফল হই, তবে নিরাপদে অবস্থান করবেন। নয়তো আপনারা আবিসিনিয়া ত্যাগ করবেন। এই আয়োজন সম্পন্ন করে তিনি এক টুকরো কাগজে লিখলেন:
‘আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আল্লাহ ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই এবং মুহাম্মদ (সা.) আল্লাহর বান্দা ও তাঁর রাসূল। আমি আরো সাক্ষ্য দিচ্ছি যে মরিয়ম পুত্র ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা, তার আত্মা ও কলেমা- যাঁকে তিনি মরিয়মের প্রতি নিক্ষেপ করেছেন।’
এ কাগজ টুকরা তিনি তার জামার নীচে বুকের কাছে লুকিয়ে রাখলেন। তারপর তিনি দরবারে আম ডেকে হাবসাবাসীদের বিভিন্ন গোত্রের গোত্রপতিদের একত্র করে জিজ্ঞেস করলেন আমার সম্পর্কে তোমাদের অভিমত কি? আমি কি তোমাদের শাসক হিসেবে যোগ্য ব্যক্তি নয়? তারা একবাক্যে জবাব দিলো আমাদের শাসক হিসেবে আপনি নিঃসন্দেহে যোগ্য ব্যক্তি, তবে আমরা শুনতে পেয়েছি যে আপনি খ্রিস্টান ধর্ম ত্যাগ করেছেন এবং ঈসা (আ.) আল্লাহর বান্দা বলে স্বীকার করে নিয়েছেন।
আসমাহা জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা হযরত ইসা (আ.) সম্পর্কে কী ধারণা পোষন করো? তরা জবাব দিলো : তিনি হচ্ছেন আল্লাহর পুত্র। আসমাহা তার হাত বুকের উপর রেখে বললেন,
‘ঈসা (আ.) এর চাইতে অর্থাৎ এই কাগজে লিপিবদ্ধ কথার চাইতে একটুও অতিরিক্ত শিক্ষা দেননি’
হাবসাবাসীরা তার কথা শান্ত হয়ে গেলো। এবং বিদ্রোহের আশংকা দূরীভূত হয়ে গেল।মুহাজিরগণ তখন নৌবহর থেকে নেমে হাবশায় অবস্থান করতে শুরু করলেন।
নবী করীম (সা.)-এর চিঠিখানা হাতীর দাঁতের তৈরি কৌটায় আবদ্ধ করে সংরক্ষিত করলেন এবং তিনি প্রায়ই বলতেন,
‘যতদিন এ বরকতময় তোহফা আবিসিনিয়া সংরক্ষিত থাকবে, ততদিন পর্যন্ত এদেশের প্রতি শত্রুর হস্ত উত্তোলিত হতে পারে না।’
আবিসিনিয়া অধিপতি নাজ্জাশীর চিঠি
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম- পরম করুনাময় আল্লাহর নামে মুহাম্মাদুর রসুলুল্লাহর প্রতি নাজ্জাশী আসহাম বিন আবু জুরের পক্ষ থেকে-
হে আল্লাহর রাসূল!আপনার প্রতি সেই আল্লাহর পক্ষ থেকে সালাম, বরকত ও রহমতরাশি বর্ষিত হোক- যিনি ব্যতীত আর কোন উপাস্য নেই । আর যিনি আমাকে ইসলামের হেদায়েত দান করেছেন।
হে আল্লাহর রাসূল ! আপনার চিঠি আমার হস্তগত হয়েছে। আপনি হযরত ঈসা আলাইহিস সালাম সম্পর্কে যা বলেছেন আসমান-যমীনের মালিকের কসম ঈসা (আ.) তার চাইতে তিল পরিমানও বেশি কিছু ছিলেন না। তিনি ঠিক ততটুকুই ছিলেন যতটুকু আপনি বলেছেন। আমি আপনার চিঠি বাহকের মাধ্যমে আপনার পরিচয় লাভ করেছি এবং আপনার পিতৃব্যপুত্র এবং তার সঙ্গী-সাথীদের আতিথ্যও প্রদান করেছি।আমি স্বীকার করি আপনি আল্লাহর রাসূল এবং সত্যায়িত রাসুল (পূর্ববর্তী কিতাবসমূহে আপনাকে প্রত্যয়ন করা হয়েছে) । আমি আপনার চাচাতো ভাই এবং তার সাথীদের মাধ্যমে আপনার নিকট বায়াত হয়েছি- আনুগত্য বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছি এবং আমি তাঁদের হাতেই আল্লাহ রাব্বুল আলামীনের দরবারে আনুগত্যের শপথ করেছি।আমি আমার পুত্র ওবায়দা বিন আসাম কে আপনার খেদমতে পাঠাচ্ছি কিন্তু আমার নিজের উপর ছাড়া আর কারো উপর আমার হাত নেই । হে আল্লাহর রাসূল আপনি যদি আমাকে তলব করেন তবে আমি নিজে আপনার খেদমতে এসে হাজির হবো । আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি যে, আপনি যা বলেন তা সব সত্য । ওয়াসসালামু আলাইকা ইয়া রাসুলাল্লাহ।ইতিআসহাম হাবশার নাজ্জাশী
উক্ত চিঠিতে নাজ্জাশী রিসালাত ও হেদায়েতের উপর তার ঈমান আনায়নের কথা ব্যক্ত করেন। কিন্তু সাথে সাথে একথা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত করেছেন যে, ইসলাম গ্রহণের ব্যাপারে তার নিজের উপর ছাড়া অপর কারো উপর তার কোন হাত নেই ।
নাজ্জাশী ইতিপূর্বে যখন তার দরবারে আগত কুরাইশ পক্ষের প্রতিনিধি আমর ইবনুল আসের জবাবে হযরত জাফর তাইয়েব তেজস্বী ভাষায় ভাষণ দিয়েছিলেন এবং হযরত এর চিঠি হস্তান্তর করেছিলেন, তখন থেকেই ইসলামের দিকে মনে মনে ঝুঁকে পড়েছিলেন। এবার যখন মদিনা থেকে এই দ্বিতীয় চিঠি খানা আসলো তখন তিনি রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর প্রতি ঈমান আনায়ন এবং সত্য ধর্ম গ্রহণের স্বীকারোক্তিও করলেন।