ঈমানী শক্তি
ঈমানী শক্তি
তুমুল লড়াই চলছে ।উত্তপ্ত রনাঙ্গন। এক দিকে লড়ে যাচ্ছে আল্লাহর সন্তুষ্টি হাসিলের জন্য নিবেদিতপ্রাণ অকুতোভয় একদল মুসলিম। অপরদিকে অন্যায় ও তাগুতী সফলতার আশায় আপন ঝান্ডা তলে শক্তি ব্যায় করে যাচ্ছে বৃহদাকার একটি শক্তি। প্রথম দলের লক্ষ্য উদ্দেশ্য কেবল আল্লাহর রেজামন্দি অর্জন । কারণ আজকের এই দিনে আল্লাহর দরবারে নিজের জিন্দেগি নজরানা পেশ করতে পারলে তার চেয়ে বড় সৌভাগ্য আর কিছুই নেই। জীবনের শেষ বিন্দুটুকু উৎসর্গ করে শহীদের কাতারে শামিল হতে পারলে তার চেয়ে বড় সাফল্য আর হতেই পারে না । অপরদিকে সম্প্রদায় কুফুরি সম্প্রদায়ের গন্তব্য হচ্ছে কিছু পার্থিব সুযোগ-সুবিধা অর্জন । অন্যায় ভাবে মুসলিম নিধন করে স্রষ্টা মনোনীত জীবন ব্যবস্থা ‘দ্বীনে ইসলামের’ ধ্বংসসাধন। উভয় দলই মানসিকভাবে বজ্রকঠিন। যে কোন ত্যাগ, বিসর্জন দিতে প্রস্তুত। সবার টার্গেট বিজয়ের মালা ।সফলতায় সকলের আশা । উভয়দলের আত্মশপথ “প্রতিপক্ষের অস্তিত্ব আজ নিঃশেষ করতেই হবে। পরাজয়ের গ্লানি দিয়ে আজ তাদের সমাধি রচনা করতে হবে।”
এরই মধ্যে রণাঙ্গন ভীষণ উত্তপ্ত হয়ে উঠলো প্রত্যেকেই মারমুখী। চকচকে তরবারীতে সূর্যের প্রতিবিম্ব সৃষ্টি হয়ে চোখ ঝলসে দেওয়ার উপক্রম। তরবারীর আওতায় যে যাকে পাচ্ছে তারই যবনিকাপাত ঘটাচ্ছে। মুসলিম সেনাদের মাঝে নবী জামাতা আলী ইবনে আবু তালেবও আছেন। তার বীরত্ব, সাহসিকতা, আপোষহীনতা, সবারই জানা। তার নাম শুনলেই কাফেরদের তনুমন কেঁপে উঠে । রণাঙ্গনে তার ভূমিকা উল্লেখ করার মতো। বীরদর্পে কাফেরদের কচু কাটার মত কাটতে লাগলেন । তার পাল্লায় কেউ পড়লেই হলো , তার কিচ্ছা খতম। আলী তার দুর্বার অভিযান নিয়ে ময়দানের অভ্যন্তরে অগ্রসর হতে লাগলেন। বেশি দূর যেতে হলোনা, সামনে পড়ল এক ইয়াহুদী, যে আল্লাহ সম্পর্কে বেয়াদবি ও অশালীন বাক্যবানের দৃষ্টতা প্রদর্শন করছে। মহানবীর ব্যাপারে কটুক্তি করছে। গালমন্দ করছে । অশ্লীল শব্দে গালিগালাজ করছে। ইসলাম ও মুসলমানদের বিপক্ষে তার রয়েছে কুটিল চক্রান্তের এক প্রসস্ত হাত। সবচেয়ে বড় কথা সে রাসূলকে ভীষণ গালিগালাজ করে। তাকে দেখামাত্রই আলীর গত্রাদাহ আরম্ভ হয়ে গেল । আলীর ঈমানী শক্তি, তাওহীদি আভিজাত্য উথলে উঠল। নবীপ্রেম তাকে অস্থির করে তুলল। হ্যাঁ, আলী বিলম্ব করতে পারলেন না। প্রথম দেখাতেই তার উপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। ব্যস, ইয়াহুদী ততক্ষণে মাটিতে লুটিয়ে পড়েছে। মাটিতে ধরাশায়ী করে আলী তার বুক চাপা দিয়ে তার উপর বসলেন। ইয়াহুদি নিরুপায়, অসহায়। আলীর কব্জায় বন্দি । আলীর ইচ্ছার পুতুল। ইয়াহুদী মৃত্যু ভয়ে ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ল।এখন বাকী শুধু তার গলায় তরবারী চালিয়ে দেয়। নিজের নিশ্চিত মৃত্যু জেনে ইয়াহুদী বেপরোয়া হয়ে উঠল। অবশেষে আলীর চেহারা মোবারকে থুতু নিক্ষেপ করল । কারণ যে ব্যক্তির সামনে মৃত্যুর দুয়ার উদ্ভাসিত হয়ে ওঠে,সে কোন কাজ করতে দ্বিধাবোধ করেনা । আলীর মুখ ছড়িয়ে গেছে ইয়াহুদীর বিশ্রী থুতুতে।
প্রিয় পাঠক! আলীর স্থানে তুমি হলে কি করতে? নিশ্চয়ই হাতের তরবারী দিয়ে অনতিবিলম্বে দেহ থেকে মাথা পৃথক করে দিতে। শিরশ্ছেদ করে দুনিয়া থেকে বিদায় করে দিতে।
আলীর জন্য এমনটি করার কথা ছিল। এক আঘাতে শিরচ্ছেদ করাই সময়ের দাবি ছিল। কিন্তু আলী ইবনে আবু তালেব পৃথিবীর ইতিহাস পাল্টে অবাক করে দিলেন।কেয়ামত অবধি গোটা মানব সম্প্রদায়কে হতবাক করে দিলেন।ইয়াহুদী আলীর মুখমন্ডলে থুতু নিক্ষেপ করার সাথে সাথে তাঁর বক্ষ হতে সরে দাঁড়ালেন আলী। ইয়াহুদী এখন মুক্ত।কিন্তু ইয়হুদী বিশ্বাস করতে পারছিল না। যেখানে তার মাথা দ্বিখন্ডিত হয়ে রক্তের বন্য বয়ে যাওয়ার কথা, সেখানে সে দিব্বি স্বাধীনতা নিঃশ্বাস ফেলছে। ইয়াহুদী বিস্মিত। ভীষণ বিস্মিত। আশ্চর্য তাকে নির্বাক করে তুলেছে ।
চিন্তার অথৈ সাগরে নিজেকে হারিয়ে ফেলেছে। আলী কি আমার প্রতি দয়া করেছে?
হতেই পারে না। নাকি আরো ভয়ঙ্কর কোন পদ্ধতি প্রস্তুতি নিচ্ছে? না, সে আর স্থির থাকতে পারলো না। রহস্য উদঘাটনের জন্য আলীকে জিজ্ঞেস করলো আপনি যদি কাফের হওয়ার অপরাধে আমাকে হত্যা করতে চান, আপনাদের নবী ও খোদা সম্পর্কে কটুক্তি করার দায়ে যদি আমার শিরশ্ছেদ করতে চান তবে থুথু মারার পর আমাকে মুক্ত করে দিলেন কেন?অথচ সময় অভিজ্ঞতার দাবী হল আমাকে মুহূর্তকালও অবকাশ না দেয়া। আত্মমর্যাদাবোধের দাবী হল এক নিঃশ্বাসে সুযোগও না দেয়া ।কিন্তু আপনি আমাকে মুক্ত করে দিলেন। পৃথিবীর মুক্ত বাতাসে কাল ক্ষেপণের সুযোগ দিলেন। অথচ আপনাকে থুতু নিক্ষেপের ফলে আমার কুফুরী অবশ্যই দূর হয়নি। পূর্ব অভ্যাসও বিদায় নেয়নি, বরং বৃদ্ধি পাওয়ার সম্ভাবনাই প্রবল।’
ইয়াহুদীর প্রশ্নে আলী জবাব দিলেন। অত্যন্ত আত্মসচেতনতার সাথে, পূর্ণ বিজ্ঞতার সাথে বললেন সত্যি তোমার কদর্য আচরণের পর তোমাকে মুক্ত করা বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিস্ময়কর । ভীষন আশ্চর্যকর। কিন্তু আমি মুমিন, রাসূলের সানিধ্যপ্রাপ্ত সহচর।মুমিনের মনযিলে মাকসুদ কেবল আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জন, রাসুলের সন্তুষ্টি অর্জন, আর তোমাকে হত্যা করায় আল্লাহ ও রাসূলের রেজামন্দি ছাড়া আর কোন উদ্দেশ্য ছিল না। কিন্তু তুমি যখন আমার চেহারায় থুতু নিক্ষেপ করেছ তখন আমার মধ্যে ক্রোধের অনল দাউ দাউ করে জ্বলে উঠেছে। প্রতিশোধের অগ্নিস্ফুলিঙ্গ সবকিছু ছারখার করে দেয়ার উপক্রম হয়েছে । তোমাকে হত্যার পিছনে ঈমানী চেতনার পাশাপাশি প্রবৃত্তির তাড়না ও অংশ নিয়েছে বিধায় এখন তোমাকে হত্যা করলে তা একমাত্র আল্লাহর সন্তুষ্টির জন্য হবে না, শুধুমাত্র নবী প্রেমের দাবি আদায় হবে না, নফসানিয়্যাত ও প্রবৃত্তির অংশীদারীত্ব এসে যাবে। আমি চাইনা প্রবৃত্তির পূজা করে স্বীয় কষ্টার্জিত পুণ্যময় কর্মকে বরবাদ করে দিতে। আমি চাইনা মনোবৃত্তিকে অংশ দিয়ে বিচার দিবসে আল্লাহর সামনে লজ্জিত হবে রিক্ত হস্তে দণ্ডায়মান হতে। তাই তোমাকে মুক্ত করে দিলাম। এখন আমার মনের চাহিদা দূরত্ব হয়ে গেছে। একমাত্র আল্লাহর রাসূলের উদ্দেশ্য তোমাকে হত্যা করতে উদ্দেশ্যে তোমাকে হত্যা করতে প্রস্তুত হয়েছি। তুমিও আবার প্রস্তুত হও আমার সাথে লড়তে …… “।
আলীর বীরোচিত নিষ্ঠাপূর্ণ কথাগুলো ইয়াহুদীর কর্ণ ভেদ করে সরাসরি অন্তরে প্রবেশ করল। আল্লাহর পথে নিবেদিত এ সৈনিকের অজাগতিক বক্তব্য তার অন্তরে গভীর রেখাপাত করল। সত্য ও সততার হাতল অনাবরত করাঘাত করে চলল। ইয়াহুদীর অন্তর খুলে গেল। খোলা চোখের দৃষ্টিতে সত্য-মিথ্যা উদ্ভাসিত হয়ে উঠলো । সে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছে ইসলামই একমাত্র সত্য ধর্ম ।ইসলামই কেবল সঠিক পথ, মুক্তি ও চির সাফল্যের আশ্রয়। ইহকাল ও পরকালিন শান্তির নিকেতন ।যে ইসলাম মানুষকে স্রষ্টার সন্তুষ্টি অর্জনে আত্মবিসর্জন দিতে শেখায়,প্রবৃত্তির অনুসরণ কে ধিক্কার দেয়, সেটাই সত্য ধর্ম।ইয়হুদী আর থাকতে পারল না। নিজের হস্তদ্বয় আলীর উদ্দেশ্যে প্রসারিত করে দিল। গভীর শ্রদ্ধাবোধ ও আন্তরিকতার সাথে তার কন্ঠে প্রতিধ্বনিত হল- আমি সাক্ষ্য দিচ্ছি, আল্লাহ ব্যতিত কোন উপাস্য নেই । আমি আরও সাক্ষ্য দিচ্ছি, মুহাম্মদ সা. আল্লাহর প্রেরিত বান্দা ও রাসূল”।