বিশিষ্ট তাবেঈ ‘আমের ইবনে ‘আব্দুল্লাহ তামিমী (রঃ) | তাবেয়ীদের জীবনী
আমের ইবনে ‘আব্দুল্লাহ তামিমী (রঃ)
“ যুহদ ও সাধনা আট ব্যক্তির মাধ্যমে সমাপ্তিতে পৌঁছে ,যাদের শীর্ষে রয়েছেন আমের ইবনে আব্দুল্লাহ তামিমী”
-আলকামা ইবনে মূরসাদ
আমরা এখন হিজরী চতুর্দশ বর্ষে ।
আমাদের সামনে বড় বড় সাহাবী ও তাবেয়ীদের কাফেলা, খলীফাতুল মুসলিমীন ওমর ইবনুল খাত্তাবের নির্দেশে যারা বসরা শহরের সীমান্ত পরিদর্শন করছেন।
তারা সংকল্প করেছেন এই নতুন শহরে পারস্যের গাজী সৈনিকদের জন্য একটি সেনা ছাউনি তৈরি করবেন।
গড়ে তুলবেন আল্লাহর পথে দাওয়াতের জন্য এক বাহিনী…..
নির্মাণ করবেন পৃথিবীতে আল্লাহর হুকুম সমুন্নত করার এক কেন্দ্র।
আর ঐ যে দেখা যায় দলে দলে মরু আরবের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ছুটে আসছেন মুসলিম জনতা, তারা আসছেন নবীন এই শহরটির দিকে।
আসছেন নজদ থেকে….
হেজায থেকে….
ইয়ামান থেকে ……..
ঐ সব অঞ্চল থেকে তারা এখানে সমবেত হচ্ছেন নবীন এই মুসলিম শহরের সীমান্ত রক্ষার জন্য।
সমাগত এই মুহাজিরদের দলে ছিলেন নজদ থেকে আসা এক তামিম গোত্রীয় তরুণ, তারই নাম আমের ইবনে আব্দুল্লাহ তামিমী আম্বরী (রহ.)।
* * * * * *
সেদিন আমের ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন উজ্জ্বল চেহারা বিশিষ্ট পরিচ্ছন্ন হৃদয় ও নির্মল আত্মার অধিকারী এক পবিত্র যুবক।
নবগঠিত বসরা ছিল সর্বাধিক ধন সম্পদ সমৃদ্ধ ও ঐশ্বর্য্য পূর্ণ একটি মুসলিম শহর। কেননা সেখানে জমা হচ্ছিল সকল গনিমত লব্ধ সম্পদ। সঞ্চিত হচ্ছিল খাঁটি সোনার স্তুপ।
কিন্তু তামিমী তরুণ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ আকর্ষণ ছিল না মোটেও এসবের প্রতি।
মানুষের ধন ঐশ্বর্যের ব্যাপারে তিনি ছিলেন ত্যাগী। আল্লাহর সম্পদ সওয়াবের প্রতি ছিলেন তিনি ভীষণ অনুরাগী।
দুনিয়া ও এর শোভার ব্যাপারে ছিলেন নিস্পৃহ, আল্লাহর সন্তুষ্টি ও আখেরাতের ব্যাপারে ছিল তার সকল আগ্রহ।
*******
সে সময় বসার প্রধানতম ব্যক্তি ছিলেন বিখ্যাত সাহাবী আবু মুসা আশ’আরী (রাযি.)।
তিনি ছিলেন সমৃদ্ধ এই শহরের গভর্নর।
তিনিই ছিলেন এখান থেকে যে কোন গন্তব্যে চলমান সৈনিকদের প্রধান সেনাপতি।
তিনিই ছিলেন এই শহরের প্রধান ইমাম, প্রধান শিক্ষক এবং হিদায়াত ও দাওয়াতের একজন তৎপর মুর্শিদ।
তাবেঈ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ আঁকড়ে ধরলেন এই সাহাবীর আস্তিন। কি রণাঙ্গনে, কি রণাঙ্গনের বাইরে সবখানেই তিনি রইলেন এই মহান সাহাবীর নিত্যসঙ্গী ও খাদেম।
তিনি তাঁর সঙ্গী হলেন দেশে ও প্রবাসে।
এই সাহাবীর কাছেই তিনি লাভ করলেন পবিত্র কোরআনের নিখুঁত ও নির্ভুল শিক্ষা, কুরআনের জ্ঞান অর্জন করলেন হুবহু সেই ভাবে, যেমন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর নাযিল করা হয়েছিল।
তাঁরই সূত্রে তিনি বর্ণনা করেছেন বিশুদ্ধ মারফু’ হাদিস।
তাঁরই কাছে অর্জন করেছেন ইসলামের সঠিক উপলব্ধি ও চেতনা।
জ্ঞান অর্জনের ঈস্পিত স্তর যখন তিনি অতিক্রম করলেন তখন নিজের জীবনকে ভাগ করে নিলেন তিন ভাগে-
এক. কুরআনের জন্য, এ সময় তিনি বসরার মসজিদে গিয়ে কুরআনের শিক্ষা দিতেন।
দুই. নির্জন ইবাদতের জন্য, এসময় তিনি নিজের নিস্তেজ না হওয়া পর্যন্ত নামাজে দাঁড়িয়ে থাকতেন তিন. এ সময় তিনি মুক্ত তরবারী নিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
এই তিন উদ্দেশ্যের বাইরে তিনি জীবনের সামান্য সময় ও ব্যায় করেননি আর এ কারণেই তিনি আখ্যায়িত হয়েছিলেন “বসরার আবিদ ও যাহিদ” নামে।
* * * * * *
বসরার জনৈক ব্যাক্তি ‘আমের ইবনে আবদুল্লাহ সম্পর্কে এরকম বর্ণনা করেন-
আমি একবার এক কাফেলার সঙ্গে সফর করছিলাম, ‘আমের ইবনে আবদুল্লাহ ছিলেন সে কাফেলার একজন সঙ্গী। চলতে চলতে যখন সন্ধা ঘনিয়ে এলো আমরা একটি ঝোঁপের নিকট পৌছে যাত্রা বিরতি করলাম।
আমের (র.) নিজের সামান একত্রিত করে ঘোড়াটিকে একটি গাছের সঙ্গে বাঁধলেন। ঘোড়া রশি কিছুটা লম্বা রাখলেন তার সামনে পরিমাণ মতো ঘাস এনে দিয়ে প্রবেশ করলেন গভীর অরণ্যে। যেতে যেতে একসময় আমার দৃষ্টির আড়াল হয়ে গেলেন। আমি সংকল্প করলাম তার পিছু নেব এবং দেখবো তিনি এতো গভীর রাতে এই গহীন বনে করেন কি ?
দেখলাম- যেতে যেতে তিনি একটি ছোট্ট টিপির কাছে থামলেন। চতুর্দিক দিয়ে ঘন গাছপালায় ঘেরা এই নির্জন টিপিতে ঢুকে তিনি নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। আমি অপলক দৃষ্টিতে সেই বিস্ময়কর দৃশ্য দেখতে লাগলাম এত পরিপূর্ণ, খুশু-খুযুপূর্ণ এবং এত চমৎকার নামাজ আমার জীবনে আর কখনো দেখিনি।
দীর্ঘ সময় ধরে নামাজ আদায়ের পর তিনি দোয়া করতে শুরু করলেন, দুহাত তুলে বলতে লাগলেন–
“হে আল্লাহ তুমি আপন নির্দেশে আমাকে সৃষ্টি করেছো অতঃপর আপন ইচ্ছায় আমাকে দুনিয়ায় নানান পরীক্ষায় ফেলে নির্দেশ দিয়েছে নিজেকে বাঁচাও ,
হে সর্বশক্তিমান তুমি আপন দয়া ও অনুগ্রহের যদি আমাকে না বাঁচাও, আমি কিভাবে নিজেকে বাঁচাবো? কিরূপে আত্মরক্ষা করবো?
হে আল্লাহ নিশ্চয়ই তুমি জানো যদি এই পৃথিবীর সমস্ত সম্পদ আমার হাতে এসে যায় এবং তোমার নামে কেউ সেটা চাইতে আসে তবে তোমার সন্তুষ্টির আশায় আমি সবি দান করে দেব।
সুতরাং আমার সন্তুষ্টি আমাকে দান করো ইয়া আরহামার রাহিমীন।
হে আল্লাহ আমি তোমাকে এমন হৃদয় উজাড় করে ভালোবাসি যা সকল মুসিবত কে আমার জন্য সহজ করে দেয় এবং আমাকে সকল ফায়সালার প্রতি সন্তুষ্ট করে দেয়।
তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আর কোনো পরোয়া করিনা।
তোমার ভালোবাসা পেলে আমি আর ফিরেও দেখি না কিভাবে আমার সকাল গেল আর কিভাবে আমার সন্ধ্যা এলো… ”
* * * * * *
বসরার লোকটি বলেন-
এই দৃশ্য দেখতে দেখতে এক সময় আমি ভীষণ ঘুমে আচ্ছন্ন হয়ে পড়লাম।
এরপর যতবার জেগেছি আমি আমেরকে সেই একই স্থানে নামাজে অথবা মুনাজাতেই দেখেছি প্রভাতের আলো ফোটা পর্যন্ত।
ফজরের সময় হলে তিনি নামাজ পড়ে আবার দোয়া করতে লাগলেন। তিনি বললেন–
“ইয়া আল্লাহ্ এই প্রভাতের এলা ফুটলো, মানুষ জীবিকার সন্ধানে সন্ধা পর্যন্ত ছুটে বেড়াবে … প্রতিটি মানুষের নানান প্রয়োজনীয়তা আছে…. অভাব আছে ….
কিন্তু আমার শুধু তোমার ক্ষমা ছাড়া আর কোন অভাব নেই, প্রয়োজন নেই।
ইয়া আল্লাহ্! তুমি আমার এবং সব মানুষের সকল অভাব মিটিয়ে দাও ইয়া আকরামাল আকরামীন! (হে মহান দয়ালু)
* * * * * *
ইয়া আল্লাহ আমি তোমার কাছে তিনটি প্রার্থনা করেছিলাম, যার দুইটি তুমি কবুল করেছ আরেকটিতে আমাকে বঞ্চিত করেছ, সেটা আমাকে দাওনি।
হে আল্লাহ! দয়া করে সেটাও আমাকে দান করো, যেন আমি প্রাণভরে তোমার ইবাদত করতে পারি।
এরপর তিনি উঠে পড়লেন, তখন হঠাৎ আমার উপর তার চোখ পড়লে তিনি বুঝতে পারলেন রাতভর আমি তাকে অনুসরণ করেছি। ফলে তিনি অস্থির হয়ে পড়লেন এবং আফসোস করে বললেন-
: “মনে হচ্ছে রাতভর আমাকে পাহারা দিয়েছো? ”
: ”হাঁ, তা দিয়েছি।” -আমি জবাব দিলাম।
“রাতভর যা দেখেছো দয়া করে সেগুলো গোপন রেখো। আল্লাহ তোমার দোষ ত্রুটি গোপন রাখবেন। ” তিনি আমাকে অনুরোধ করলেন।
আমি তখন বললামঃ
“আল্লাহর কসম! হয়তো আমাকে আপনার তিনটি প্রার্থনার কথা বলবেন, না হয় যা দেখেছি সেটা সব মানুষের কাছে বলে দেবো” ।
তিনি বললেন-“ দূর বোকা! এমন করো না ।
আমি বললাম – “তাহলে আমি যা বললাম তাই করুন……”
এভাবে বারবার আমার জিদ দেখে তিনি বললেন-
ঠিক আছে, বলবো তবে তোমাকে আল্লাহর নামে কসম করে বলতে হবে যে একথা তুমি কারো কাছে প্রকাশ করবে না।
আমি বললাম – আমি আল্লাহর নামে কসম করছি যতদিন আপনি বেঁচে থাকবেন ততদিন এই রহস্য প্রকাশ করবো না ।
তিনি বলতে শুরু করলেন-
“ দ্বীনের ব্যাপারে নারী ছিল আমার কাছে সর্বাধিক ভয়ংকর, ফলে আমি প্রার্থনা করেছিলাম যেন আল্লাহ আমার অন্তর থেকে তাদের ভালোবাসা দূর করে দেন। তিনি এই দোয়া কবুল করেছেন ফলে এখন আমি একজন নারী এবং একটি দেয়ালের প্রতি দৃষ্টির মাঝে কোন পার্থক্য বুঝি না ।
এ দুটি আমার মনে কোন আলাদা অনুভূতি জন্মায় না ।
আমি বললাম- “এত হল একটি, দ্বিতীয় টি কি? “
তিনি বললেন – “আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেছিলাম আমার অন্তরে যেন তিনি ছাড়া আর কারো ভয় না থাকে, যেন আমি শুধুমাত্র তাকেই ভয় করি। এটাও তিনি কবুল করেছেন এখন আসমান জমিনে তাকে ছাড়া আর কাউকে আমি বিন্দুমাত্র ভয় পাইনা।
: তৃতীয়টি কি ? – আমি জিজ্ঞাসা করলাম ।
: আমার ঘুম দূর করে দেয়ার জন্য আমি আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করে ছিলাম যেন আমি রাত দিন প্রাণভরে তাঁর ইবাদত করতে পারি। আমার এই দোয়াটি কবুল হয়নি ।
আমি তার এ বিবরণ শুনে বললাম-
“ নিজের শরীরের ওপর একটু রহম করুন, আপনি তো রাতভর নামায আর দিনভর রোজা রেখেছেন…..
যে আমল আপনি করছেন তার সামান্যতেই জান্নাত অবধারিত, আর যে ক্লেশ আপনি সহ্য করছেন তার সামান্যতেই জাহান্নাম থেকে মুক্তিও নিশ্চিত ।
: “কিন্তু আমার ভয় হয় নাজানি কিয়ামতের ময়দানে আমাকে আল্লাহর সামনে লজ্জিত হতে হয়, যা তখন কোনই কাজে আসবে না !
আর এই ভয়েই আমি যখনই সুযোগ পাই ইবাদতের চেষ্টা করি।
যদি আমি যদি নাজাত পেয়ে যাই , তবে সেটা হবে আল্লাহর অসীম রহমত।
আর যদি জাহান্নামের ফয়সালা হয় তবে সেটা হবে আমারই অবহেলা ও অলসতার ফল। ”
*******
আমের ইবনে আব্দুল্লাহ যেমন ছিলেন ইবাদাত ইবাদত গুজার তেমনি ছিলেন একজন ঘোড়সওয়ার মুজাহিদও।
যখনই জিহাদ ফি সাবিলিল্লাহ আহ্বান আসতো সেখানে তিনি থাকতেন সর্বাগ্রে সাড়াদানকারী।
তিনি কোন রণাঙ্গনে শরীক হলে সর্বপ্রথম মুজাহিদদের মাঝে নিরীক্ষণ চালিয়ে কিছু লোক বাছাই করতেন এরপর তাদের ডেকে বলতেন-
আমি তোমাদের সঙ্গে হতে চাই যদি আমার তিনটি শর্তে তোমরা রাজি থাকো
কী শর্ত?
এক. আমি তোমাদের খেদমত করব এ ব্যাপারে তোমরা কেউ আপত্তি করতে পারবে না।
দুই. আমি সব সময় নামাযের আযান দিবো, অন্য কেউ আজান দেয়ার দাবি জানাতে পারবে না
তিন. আমি সামর্থ্য অনুযায়ী তোমাদের জন্য খরচ করবো তোমরা কেউ বাধা দিতে পারবে না
এগুলো সবাই এক বাক্যে মেনে নিলে তিনি তাদেরকে বুকে জড়িয়ে নিতেন
আর তাদের কোন একজনও যদি কোন একটি বিষয়ে আপত্তি করত তবে তাদেরকে তিনি বিদায়ী সালাম জানাতেন।
আমের (রহ.) ছিলেন সেই বিরল মুজাহিদদের একজন যারা রক্ত দেয়ার সময় হলে থাকতেন থাকেন সবার আগে আর গনিমত বন্টনের সময় সবার পিছে।
ফলে রণাঙ্গনে তিনি ঝাঁপিয়ে পড়তেন এমন বিক্রমে যা আর কারো পক্ষেই সম্ভব হতো না তিনি দূরে সরে থাকতে এমন ভাবে যা সাধারনত অন্য কেউ করে না
*******
প্রাসঙ্গিক ঘটনা
সাদ ইবনে আবি আক্কাস (রাযি.) কাদেসিয়ার যুদ্ধ শেষে পারস্য সম্রাট কেসরার রাজপ্রসাদে অবতরণ করলেন ।
তিনি ওমর ইবনে মোকাররানকে নির্দেশ দিলেন সমস্ত গনিমতের মাল জমা করে হিসাব করতে। কেননা এক পঞ্চমাংশ বাইতুলমালে পাঠিয়ে অবশিষ্ট মাল তিনি ভাগ করে দেবেন মুজাহিদদের মাঝে।
তাঁর সামনে জমা হল বিভিন্ন প্রকার দানি ও উত্তম সম্পদ -যা বর্ণনার অতীত এবং গণনারও অতীত।
সঞ্চিত সম্পদরাশির মধ্যে আছে- সীসা দ্বারা সীল করা এক বিশাল ঝুড়ি, যাতে ঠাসা রয়েছে পারস্য সম্রাটদের সমস্ত স্বর্ণ, রৌপ্যের থালা-বাসন।
আছে -উত্তম ও দামি কাঠের তৈরি অনেক বাক্স ।যেগুলোতে ঠেসে ঠেসে রাখা হয়েছে কেসরাদের কাপড়-চোপড় এবং মনি মুক্তার প্রলেপ দেওয়া বহু বর্ম ও কন্ঠহার।
আছে আরো দুর্মূল্য আতর ও সুগন্ধির বেশ কয়েকটি বড় বড় বাক্স।
এছাড়াও রয়েছে নারীদের সাজ-সরঞ্জাম অলংকার ইত্যাদির বিস্ময়কর সমাহার।
এখানে রয়েছে পর্যায়ক্রমে পারস্য সম্রাটদের আলাদা আলাদা খাপবদ্ধ তরবারী।
রয়েছে সেইসব রাজা-বাদশা ও সেনাপতিদের তরবারী যারা যুগে যুগে বশ্যতা মেনে নিয়েছে পারস্যের।
******
কর্মচারীরা যখন সকলের উপস্থিতি এইসব গনিমতের মাল হিসাব করছিল তখন হঠাৎ সেখানে ভীষণ ওজনের বিশাল একটি বাক্স নিয়ে হাজির ধূলিমলিন বেশও এলোমেলো কেশধারী এক লোক।
লোকটির বেশভূষায় সবাই ভাবল- এ আবার কোন আপদ এল!
কিন্তু এত তাচ্ছিল্য ভরা দৃষ্টি যখন লোকটির উপর থেকে সরে বাক্সটির উপর পড়লো তখন বিস্ময়ের ধাক্কা খেয়ে তারা সবাই সোজা হয়ে বসলো। ভাবলো- এত চমৎকার বাক্সতো জীবনে আর চোখে পড়েনি! এমনকি এখানে এই যে বিপুল গনিমত কিন্তু এসবের কোনো একটিও কি এর মত কিংবা অন্তত এর কাছাকাছি হবার যোগ্য?!
এরপর যখন বাক্সটির ভেতরে তাদের চোখ পড়ল তখন তো তাদের বাকরুদ্ধ হবার জোগাড়, কারণ চমৎকার সেই বাক্সটি ছিল দুষ্প্রাপ্য সব মানিক্য মুক্তা দিয়ে ভরা….
ফলে তাচ্ছিল্যপূর্ণ দৃষ্টির শিকার সেই এলোকেশ ও মলিন বেশ ধারী সকলের নতুন এক ধরনের দৃষ্টির শিকার হলো যার বাঙ্ময় প্রকাশ ধ্বনিত হলো কারো কারো কণ্ঠে-
: “কিন্তু তুমি পেলে কোতায় এই অমূল্য সম্পদের খনি? ! – তাদের সুরে ফুটে উঠলো অসম্ভব বিস্ময় ও জিজ্ঞাসার তীব্র প্রকাশ।
: “অমুক যুদ্ধে -অমুক স্থানে গনীমত পেয়েছি…।” লোকটির গায়ে না মাখা উত্তর।
: “তুমি কিছু সরিয়ে রাখনি তো? “
: আল্লাহ তোমাদের ভ্রান্তি দূর করুন…..
এই বাক্স এবং পারেস্যের যাবতীয় সম্পদ আমার কাছে কর্তিত নখের বরাবরও তো নয়….
এতে যদি বাইতুল মালের হক্ব জড়িত না থাকতো তবে আল্লাহর কসম আমি ‘ওটা ছুঁয়েও দেখতাম না।
আমি নিতে চাইলে “কিছু ”কেন পুরোটাই সরিয়ে রাখলে তোমরা জানতে কিভাবে ?
আমি সরাতে চাইলে কেন এত কষ্ট করে ওঠে এখানে টেনে আনবো?
: কে তুমি হে মহান ব্যক্তি ? কি তোমার নাম ? রাজ্যের শ্রদ্ধা ও সমিহ এসে ভর করল এবার তাদের কণ্ঠে।
: “না,- না, সেটা তোমাদের জানার দরকার নেই।
আমার নাম ধরে তোমরা প্রশংসা করবে? অন্যদের কাছে আমার সুনাম ও খ্যাতি ছড়াবে? আমাকে ফুলাবে ?
আল্লাহর কসম তা আমি চাই না, আমি সেটা হতে দেবোনা।
আমি শুধু মহান আল্লাহর কাছে মহান আল্লাহর প্রশংসা করছি । তাঁর কাছেই এর বিনিময় চাচ্ছি। “
এ কথাগুলো বলে তিনি সেখান থেকে সরে পড়লেন।
লোকটির নাম-ধাম জানার জন্য তারা নিজেদের একজন লোককে তার পিছে পিছে পাঠালো।
অনুসরণকারী লোকটি মলিন বেশধারীর অজ্ঞাতসারে তার পিছে পিছে যেতে লাগলো ।
তিনি স্বগোত্রীয়দের মাঝে পৌঁছে সালাম-কালাম করছিলেন, অনুসরণকারী দূর থেকে তাকে দেখিয়ে একজনকে জিজ্ঞাসা করলো-
: আচ্ছা ঐ লোকটি কে ?
: আশ্চর্য তুমি তাকে চেনো না তিনি তো বসরার বিখ্যাত আবিদ ও যাহিদ আমের ইবনে আব্দুল্লাহ তামিমী (রহ.)।
********
এতো কিছু সত্বেও আমের ইবনে আব্দুল্লাহ জীবন নির্ঝঞ্ঝাট ছিল না , ছিল না মানুষের নির্যাতনমুক্ত।
সত্য প্রকাশ ও অন্যায় প্রতিরোধের নামের আড়ালে একদল লোক তার বিরুদ্ধে তৎপর হয়ে উঠেছিল।
প্রত্যক্ষভাবে যে ঘটনার কারনে তিনি নির্যাতিত হয়েছিলেন সেটা ছিলো এরূপ-
বসরার এক পুলিশ ঘাঁড় ধরে এক যিম্মীকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে ….
জিম্মি সাহায্যের জন্য চিৎকার করছে …….
ঃ“বাঁচাও…. বাঁচাও …. ”
হে মুসলিম সমাজ ! তোমাদের নবীর আশ্রিত কে বাঁচাও…..
চিৎকার শুনে হযরত আমের এগিয়ে এলেন এবং যিম্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন-
ঃ তোমার কি কর বাকী পড়েছে ?
ঃ “জ্বি না হুজুর ! একদম হাল পর্ডন্ত শোধ করা আছে ।”
এবার পুলিশকে জিজ্ঞাসা করলেন-
: কী চাও এর কাছে?
: আমি ওকে বলেছি আমার সঙ্গে যেতে হবে; দারোগার বাগান সাফ করতে হবে।
: “তুমি কি এতে রাজী? “ – তিনি আবার যিম্মীকে জিজ্ঞাসা করলেন।
: “কক্ষনো না “
এতে আমি দুর্বল হয়ে পড়ি, তাছাড়া এই কাজের পর আমার উপার্যনের সময় থাকে না ….
আমের (রহ.) গম্ভীর স্বরে পুলিশকে বললেন
: ”ওকে ছেড়ে দাও বলছি … “
: পুলিশের ঔদ্ধতপূর্ণ জবাব।
আর এক মুহূর্তের বিলম্ব সহ্য হলো না আমেরের (রহ.); গায়ের চাদর খুলে তিনি গর্জে উঠলেন—
: আল্লাহর কসম ! আমার শরীরে এক ফোটা রক্ত থাকতেও মুহাম্মদ (সা.) এর অঙ্গীকার ভঙ্গ হতে দেবো না। “
হৈচৈ শুনে সেখানে জমে গেলো বহু মানুষ, ঘটনা শোনার পর সবাই পুলিষের উপর ক্ষিপ্ত হলো এবং জোরপূর্বক তার হাত থেকে যিম্মীকে মুক্ত করলো।
এতে পুলিশ বাহিনী ক্ষিপ্ত হয়ে চক্রান্ত করে আমেরের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ চাপালো। তাঁর বিরুদ্ধেবেশ কয়েকটি মিথ্যা অপবাদ খাড়া করলো-
*তিনি আহলুস্ সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পরিপন্থী।
*তিনি বিবাহের সুন্নাতকে অস্বীকার করেন।
*কোন প্রাণীর দুধ ও গোস্ত খান না। হালাল মনে করেন না।
এসব কথা আমীরুল মুমিনীন ‘উসমান (রাযি.) এর দরবারে উত্থাপিত হলো।
********
খলিফা বসরার গভর্নরকে নির্দেশ পাঠালেন আমের ইবনে আবদুল্লাহকে ডেকে অভিযোগ সম্পর্কে
জিজ্ঞাসাবাদ করে সর্বশেষ ফলাফল তাঁকে জানাতে।
গভর্নর তাঁকে ডেকে খলীফার নির্দেশের কথা শোনালে আমের বললেন-
: “আপনি আমীরুল মুমিনীনের নির্দেশ পালন করুন, জিজ্ঞাসা করুন ।”
গভর্নর জিজ্ঞাসা করলেন –
: “ আপনি কি বিবাহের সুন্নাতকে অস্বীকার করেন ? “
তিনি জবাব দিলেন –
: “মোটেও না । বিবাহের সুন্নাতকে আমি কখনোই অস্বীকার করি না ।
আমি জানি- ইসলামের সন্ন্যাস যাপনের সুযোগ নেই, তথাপিও আমি বিবাহ করিনি, তার কারণ –আমি এমনই দুর্বল ও অসহায় একজন মানুষ যার আশঙ্কা রয়েছে- আল্লাহর জন্য সম্পূর্ণ সমর্পিত হৃদয়টি হয়তো স্ত্রীর কাছে পরাজিত হয়ে যাবে। “
: “আপনি গোস্ত খান না কেন?”
: “না পেলে খাবো কিভাবে ? খেতে ইচ্ছা করলে এবং তখন পেয়ে গেলে ঠিকই খাই । “
: “পনীর কেন খান না? “
: কারণ আমার এলাকায় পনীর তৈরী করে অগ্নিপূজকেরা, যাদের কাছে ছাগলের জবাই করা এবং মরার মাঝে কোন ভেদাভেদ নেই। ফলে কোন পনীর হালাল আর কোনটি হারাম তা নির্ণয় করতে পারি না। তবে যদি দু‘জন মুসলমান বলে যে, এটা জবাই করা ছাজলের তৈরী , তখন আমি খেতে মোটেও দ্বিধা করি না।
: “আমীর উমারাদের মজলিসে যান না কেন? “
: “তোমাদের দুয়ারের প্রার্থী তো অনেক আছে; তাদেরকে ডেকে ডেকে কাছে বসাও….
তাদের অভাব অভিযোগগুলো মিটিয়ে দাও….
তোমাদের দুয়ারে যার কোন প্রার্থনা নেই তাকে আপন পথে চলতে দাও ।”
আমীরুল মুমিনীনের দরবারে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে পৌছানো হলো, কিন্তু তার মধ্যে রাষ্ট্রদ্রোহিতার চিহ্ন তিনি খুজে পেলেন না। পেলেন না আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের পরিপন্থী হওয়ার কোন প্রমাণও।
তবে এও সত্য যে তার বক্তব্যে বিশৃঙ্খলা আর আগুন নিভলো না ……
বরং নানান কথার ফানুস তাঁকে ঘিরে বাতাসে উড়তে লাগলো।
ক্রমেই তার সমর্থক ও বিরোধীদের মাঝে ভয়াবহ ফেৎনা ধূমায়িত হতে লাগলো ।
ফলে উসমান (রাযি.) তাকে সিরিয়ায় প্রত্যাবাসনের নির্দেশ দিলেন ……
সিরিয়ার গভর্নর মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান নির্দেশ পাঠালেন-
ভালোভাবে তার দেখভাল করতে এবং তার মর্যাদার প্রতি যত্নবান হতে।
*******
যেদিন সিরিয়ার উদ্দেশ্যে তিনি বের হলেন সেদিন তাঁকে বিদায় জানাতে তার ভাই-বন্ধু ছাত্র ও ভক্তের এক বিরাট দল বসরার পথে নেমে আসলো ।
তারা শহর ছেড়ে মারবাদ অঞ্চলে পৌঁছলে তিনি সকল ভক্তকে বললেন-
: এখন আমি দোয়া করবো, আপনারা আমীন বলুন ….. একথা শুনে সকলের নড়াচড়া বন্ধ হয়ে গেল, ঘাড় উঁচু করে সবাই শেষবারের মতো তাকে দেখতে লাগলো ।
তিনি দু’হাত তুলে মুনাজাত করতে লাগলেন-
“ইয়া আল্লাহ্ ! যেসব লোক আমার বিরুদ্ধে কুৎসা রটিয়েছে , অন্যায় ভাবে আমার উপর মিথ্যা অপবাদ দিয়েছে, যারা আমাকে মাত্রুভূমি থেকে বহিষ্কারের জন্য দায়ী এবং যারা আমার ও আমার পরম বন্ধু স্বজনদের মাঝে বিচ্ছেদের জন্য দায়ী ….
ইয়া আল্লাহ ! ইয়া আল্লাহ ! আমি তাদেরকে ক্ষমা করে দিলাম, দয়া করে তুমি তাদের ক্ষমা করে দাও…
ইয়া আল্লাহ্ ! তুমি তাদের দ্বীন ও দুনিয়াকে সুন্দর করে দাও ….
তুমি আমাকে, তাদেরকে এবং সমস্ত মুসলমানকে তোমার রহমত, ক্ষমা ও অনুগ্রহ দ্বারা আচ্ছন্ন করে দাও, ইয়া আরহামার রাহিমীন।! “
এরপর তিনি বাহনের মুখ ঘুরিয়ে দিলেনসিরিয়ার দিকে, অতঃপর সম্পূর্ণ নতুন এই গন্তব্যের দিকে এগিয়ে গেলেন।
*******
হযরত আমের ইবনে আব্দুল্লাহ জীবনের বাকি দিনগুলো কাটিয়েছেন সিরিয়াতেই। সেখানে তিনি বাইতুল মুকাদ্দাস কে গ্রহণ করেছিলেন আপন আবাস হিসাবে । সেখানে তিনি আমির মুয়াবিয়া ইবনে আবি সুফিয়ান এর প্রচেষ্টায় লাভ করেছিলেন উপযুক্ত সম্মান ও মর্যাদা ।
এরপর যখন তিনি মৃত্যুশয্যায় শায়িত, ভক্তবৃন্দ খবর পেয়ে তাঁর কাছে সমবেত হলেন, তারা দেখতে পেলেন – তিনি অঝোরে কাঁদছেন।
: বৃথাই কেন অশ্রু ঝরাচ্ছেন, আপনি ছিলেন বসরার আবিদ ও যাহিদ “
তিনি বললেনঃ
“ আল্লাহর কসম আমি দুনিয়ার লোভে অথবা মৃত্যুর ভয়ে কাঁপছি না, আমার ভয় শুধু এতটুকুই যে হায়! আখেরাতের সফর কতই না দীর্ঘ আর আমার পাথেয় কতই না স্বল্প ।
আমি পৌঁছে গেছি জীবনের শেষ সন্ধ্যায়, আমি এখন ভয়ংকর এক উত্থান পতনের মাঝে অনিশ্চিত গন্তব্যের দোলায় দোদুল্যমান ।
হয়তো জান্নাত ….. নয় তো জাহান্নাম …..
আমি জানিনা কোন টি আমার চূড়ান্ত মনযিল …….
অতঃপর তিনি জীবনের শেষ কয়েকটি নিঃশ্বাস ত্যাগ করলেন, তখন তার জিব্বা ছিল আল্লাহর যিকিরে সিক্ত …..
ঐখানেই ….
ঐ প্রথম কেবলার পবিত্র মাটিতে ….
তৃতীয় হারামের পুণ্যভূমিতে …….. রাসূলুল্লাহ (সা.) এর মে‘রাজ গমনের স্থানে …..
চির নিদ্রায় শায়িত আছেন আমের ইবনে আবদুল্লাহ তামীমী …
******
আল্লাহ তাআলা আমের (রঃ) এর জন্য তাঁর কবরকে আলোকিত করুন ….চিরস্থায়ী জান্নাতে তাঁর মুখ উজ্ঝল করুন ….