ইমাম ইব্ন কাসীরের (রহঃ) জীবনী


ইমাম ইব্ন কাসীরের (রহঃ) জীবনী
      ইতিহাসের পৃষ্ঠায় যে সমস্ত তাফসীর শাস্ত্রজ্ঞ, মুহাদ্দিস, ফাকীহ, ধর্মীয় জ্ঞান, তত্ত্ব ও শাস্ত্রালোচনায় বিপুল পারদর্শিতা ও সর্বতোমুখী প্রতিভার পরিচয় দিয়ে এই মর-জগতের বুকে অমরত্ব লাভ করেছেন এবং যেসব মনীষী পবিত্র কুরআন, হাদীস তথা শাশ্বত সুন্নাহর বিজয় নিকেতন সুপ্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হয়েছেন, তন্মধ্যে হাফিয ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইব্ন কাসীরের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য। তাঁর প্রকৃত নাম ইসমাঈল, আবুল ফিদা তাঁর কুনিয়াত বা উপনাম এবং ইমাদুদ্দীন (ধর্মের স্তম্ভ) তাঁর উপাধি। সুতরাং তাঁর শাজরা-ই-নাসাববা কুলজীনামাসহ পূরা নাম ও বংশ পরিচয় হচ্ছে-
     আবুল ফিদা ইমাদুদ্দীন ইসমাঈল ইব্ন উমার ইব্ন কাসীর ইব্ন যার আল-কারশী, আল-বাসরী, আদ্ দিমাশকী।
কিন্তু সাধারণ্যে তিনি ইব্ন কাসীর নামেই সমধিক প্রসিদ্ধ। বস্তুতঃ আলবাসরীনামক তাঁর এই নিসবাতটি হচ্ছে জন্মস্থান বাচক উপাধি এবং আদ্ দিমাশকীনামক তাঁর এই নিসবাতটি হচ্ছে তাঁর শিক্ষা-দীক্ষা বা তালীম ও তারবিয়াত বাচক উপাধি।
জন্ম ও শিক্ষা-দীক্ষা-
      ইমাম ইব্ন কাসীর (রহঃ) সিরীয়া প্রদেশের প্রসিদ্ধ শহর বাসরার অধীন মাজদাল নামক মহল্লায় ৭০১ হিজরীতে জন্মগ্রহণ করেন। ইব্ন কাসীরের জন্মের সময়ে তাঁর পিতা সেই অঞ্চলের খতীব পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। চার বছর বয়সে শিশু ইব্ন কাসীরের স্নেহময় পিতা শিহাবুদ্দীন উমার ৭০৫ হিজরী মুতাবিক ১৩০৩ খৃষ্টাব্দে ইন্তিকাল করেন। তখন তাঁর জ্যেষ্ঠ সহোদর শাইখ আবদুল ওয়াহাব তাঁর প্রতিপালনের দায়িত্বভার গ্রহণ করেন।
ইব্ন কাসীরের (রহঃ) শিক্ষকবৃন্দ-
     তিনি জ্যেষ্ঠ ভাইয়ের কাছে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপন করে ফিকাহ শাস্ত্রের অধ্যয়ন শুরু করেন। অতঃপর শাইখ বুরহানুদ্দীন ইবরাহীম ইব্ন আবদুর রাহমান ফাযারী (মৃত্যু ৭২৯ হিজরী/১৩২৮ খৃষ্টাব্দ) এবং শাইখ কামালুদ্দীন ইব্ন কাযী শুহবার কাছে ফিকাহ শাস্ত্রের পাঠ সমাপ্ত করেন। মুহাদ্দিস হাজ্জার ছাড়া তাঁর সমসাময়িক যেসব মুহাদ্দিসের কাছ থেকে ইমাম ইব্ন কাসীর একাগ্র চিত্তে হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়ন করেছিলেন তাঁদের মধ্যে নিম্নোক্ত মনীষীদের নাম বিশেষভাবে উল্লেখ্য
উল্লেখযোগ্য শিক্ষকদের নাম-
১) বাহাউদ্দীন ইব্ন কাসিম ইব্ন মুযাফ্ফর ইব্ন আসাকির (মৃত্যু ৭২৩ হিজরী/১৩২৩ খৃষ্টাব্দ)
২) শাইখুয্ যাহিরিয়া আফীফুদ্দীন ইসহাক ইব্ন ইয়াহিয়া আল আমিদী (মৃত্যু ৭২৫ হিজরী/১৩২৪খৃষ্টাব্দ)
৩) ঈসা ইবনুল মুত্ইম।
৪) মুহাম্মাদ ইব্ন যারাদ।
৫) বদরুদ্দীন মুহাম্মাদ ইব্ন ইবরাহীম ইব্ন সুয়াইদী (মৃত্যু ৭১১ হিজরী/১৩১১ খৃষ্টাব্দ)
৬) শাইখুল ইসলাম তাকিউদ্দিন আহমাদ ইব্ন তাইমীয়া আল হাররানী (মৃত্যু ৭২৮ হিজরী/ ১৩২৭ খৃষ্টাব্দ)।
৭) ইব্নুর রাযী।
৮) আহমাদ ইব্ন আবী তালিব (ইবনুশ শাহনাহ) (মৃত্যু ৭৩০ হিজরী)
৯) ইবনুল হাযযার (মৃত্যু ৭৩০ হিজরী)
১০) আলী ইব্ন উমার আস সুওয়াইনী
১১) আবূ মূসা আল কারাফাই
১২) আবুল ফাত্হ আল দাব্বুসী
১৩) ইব্নুর রাযী।
১৪) হাফিয জামালুদ্দিন ইউসুফ আল মযযী শাফিঈ (মৃত্যু ৭৪২ হিজরী/১৩৪১ খৃষ্টাব্দ)।
১৫) আল্লামা হাফিয শামসুদ্দীন যাহাবী (মৃত্যু ৭৪৮ হিজরী/১৩২৭ খৃষ্টাব্দ।
১৬) আল্লামা ইমাদুদ্দীন মুহাম্মাদ ইব্ন আশ-শীরাযী (মৃত্যু ৭৪৯ হিজরী/১৩৪৮ খৃষ্টাব্দ)।
      হাফিয ইব্ন কাসীর (রহঃ) উপরোক্ত মুহাদ্দিসদের মধ্যে যাঁর কাছ থেকে সব চেয়ে বেশি শিক্ষা-দীক্ষার সুযোগ লাভ করে উপকৃত হয়েছিলেন তন্মধ্যে তাহযীবুল কামালপ্রণেতা সিরীয়া দেশীয় মুহাদ্দিস আল্লামা হাফিয জামালুদ্দিন ইউসুফ ইব্ন আবদুর রাহমান মিয্যী শাফিঈ (মৃত্যু ৭৪২ হিজরী/১৩৪১ খৃষ্টাব্দ) বিশেষভাবে উল্লেখের দাবীদার।
ইমাম ইব্ন কাসীরের প্রতি সমসাময়িক মনীষীদের শ্রদ্ধা নিবেদন
হাফিয শামসুদ্দীন যাআবী (মৃত্যু ৭৪৮ হিজরী/১৩৪৭ খৃষ্টাব্দ) তাঁর আলমুজামুল মুখতাসএবং তাযকিরাতুল হুফ্ফাযনামক অনবদ্য গ্রন্থদ্বয়ে বলেন-

ইব্ন কাসীর একজন খ্যাতনামা মুফ্তী (ফাতওয়া প্রদানে বিশেষজ্ঞ), বিজ্ঞ মুহাদ্দিস, আইন অভিজ্ঞ ফিকাহ শাস্ত্রবিদ, বিচক্ষণ তাফসীরকার এবং রিজাল শাস্ত্রে বিশেষ পারদর্শী। হাদীসের মতন (মূল অংশ) সম্পর্কে তাঁর অভিনিবেশ ছিল উল্লেখযোগ্য।
    হাফিয হুসাইনী এবং আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতী তাঁদের নিজ নিজ গ্রন্থে ইমাম ইব্ন কাসীর সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন- তিনি হাদীসের বিশিষ্ট অধ্যাপক, হাদীস শাস্ত্রের হাফিয, প্রখ্যাত আলিম এবং ইমাম, বক্তৃতায় সুনিপুণ এবং বহু গুণ ও উৎকর্ষের অধিকারী।
     আল্লামা শাইখ ইব্ন ইমাদ হাম্বালী (মৃত্যু ১০৮৯ হিজরী/১৬৭৮ খৃষ্টাব্দ) ইমাম ইব্ন কাসীরকে (রহঃ) আল হাফিযুল কাবীরবা মহান হাফিয অর্থাৎ কুরআনের শ্রেষ্ঠ শ্রতিধর বলে আখ্যায়িত করেন।
অনুরূপভাবে তাঁর খ্যাতনামা প্রিয় শিষ্য আল্লামা হাফিয ইব্ন হজ্জি (মৃত্যু ৮১৬ হিজরী/১৪১৩ খৃষ্টাব্দ) স্বীয় শ্রদ্ধাস্পদ উস্তাদ (ইব্ন কাসীর) সম্পর্কে অভিমত জানাতে গিয়ে বলেন -
      আমরা যেসব হাদীস শাস্ত্রজ্ঞকে পেয়েছি তন্মধ্যে তিনি (ইব্ন কাসীর) হাদীসের মতন বা মূল অংশ সম্পর্কে শ্রেষ্ঠ শ্রুতিধর এবং দোষ-ত্রুটির ব্যাপারে, হাদীস রিজাল শাস্ত্র জ্ঞানে ও বিশুদ্ধ-দুর্বল হাদীস নির্ধারণে ছিলেন সবার চেয়েঅভিজ্ঞ। তাঁর সমসাময়িক উলামা ও উস্তাদবৃন্দ সবাই তাঁর এই মান মর্যাদার কথা এক বাক্যে স্বীকার করেন। তাঁর কাছে আমি বহুবার যাতায়াত করেছি, তবু এ কথা স্বীকার করতে দ্বিধা নেই যে, যতবারই আমি তাঁর খিদমাতে গিয়ে উপনীত হয়েছি, প্রতিবারই কোন না কোন বিষয়ে তাঁর কাছে জ্ঞানলাভে ধন্য ও কৃতার্থ হয়েছি। আল্লামা হাফিয ইব্ন নাসিরুদ্দীন আদ্-দিমাশকী (মৃত্যু ৮৪২ হিজরী/১৪৩৮ খৃষ্টাব্দ) তাঁর (ইব্ন কাসীরের) প্রসঙ্গে বলেন-
        আল্লামা হাফিয ইমাদুদ্দীন ইব্ন কাসীর ছিলেন মুহাদ্দিসগণের নির্ভর, ঐতিহাসিকদের অবলম্বন এবং তাফসীর বিদ্যা বিশারদদের উন্নত ধ্বজা হাফিয ইব্ন হাজার আসকালানী (৮৫২ হিজরী) তাঁর আদ্দুরারুল কামীনাগ্রন্থে বলেন-
      হাদীসের মতন বা মৌল অংশ এবং রিজাল বা চরিত-অভিধান শাস্ত্রের পঠন-পাঠন ও অধ্যয়নে তিনি সব সময় নিমগ্ন থাকতেন। তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও স্মৃতিশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর, আর তিনি রসিকতা-প্রিয় ছিলেন। জীবদ্দশায় তাঁর গ্রন্থরাজি চারদিকে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে
তিনি যেমন ছিলেন লিখা-পড়ায় অত্যন্ত পরিশ্রমী এবং জ্ঞান অন্বেষণে ছিলেন অত্যন্ত তৎপর, তেমনি তার ছিল ক্ষুরধার লেখনী। ফিক্হ, তাফসীর এবং হাদীস শাস্ত্রে তার ছিল পূর্ণ দখল। পড়ালেখার সাথে সাথে তিনি বই পুস্তক লিখা ও দীনের প্রচার কাজে নিজকে ব্যস্ত রেখেছিলেন।
ঐতিহাসিকগণও ইমাম ইব্ন কাসীরের (রহঃ) সর্বতোমুখী প্রতিভা, স্মৃতিশক্তি এবং অগাধ জ্ঞানের গভীরতা সম্পর্কে ভূয়সী প্রশংসা করেন।
প্রসঙ্গে আল্লামা ইব্ন ইমাদ (মৃত্যু ১০৯৮ হিজরী/ ১৬৭৮ খৃষ্টাব্দ) বলেন -
     তাঁর উপস্থিত বুদ্ধি ও ধীশক্তি ছিল অত্যন্ত প্রখর। কোন বিষয়কে একবার মুখস্থ করে নিলে তাঁর বিস্মরণ খুব কমই হত। আর তিনি মেধাবীও কম ছিলেননা। আরাবী সাহিত্যও তিনি সৃষ্টি করেছেন এবং মধ্যম পর্যায়ের কবিতাও তিনি রচনা করতেন
আল্লামা ইব্ন তাইমিয়ার সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক
     ইব্ন কাসীরের স্বনাম খ্যাত শ্রদ্ধেয় শিক্ষক আল্লামা হাফিয ইব্ন তাইমিয়ার সঙ্গে তাঁর ঘনিষ্ট নিবিঢ় সম্বন্ধ থাকার কারণে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জন ব্যাপারে এই শিষ্যের উপর উস্তাদের প্রভাববিস্তার করেছিল অতি প্রগাঢ়ভাবে। ইব্ন কাসীর অধিকাংশ মাস্য়ালায় হাফিয ইব্ন তাইমিয়ার অনুসারী ছিলেন।
ইব্ন কাযী শাহাবা স্বীয় তাবাকাতগ্রন্থে বলেন-
      আল্লামা ইমাম ইব্ন তাইমিয়ার সঙ্গে তাঁর নিবিঢ় সম্পর্ক ছিল। শুধু তাই নয়, তিনি ইব্ন তাইমিয়ার মত ও পথকে পূর্ণ সমর্থন যুগিয়ে বিতর্ক করতেন এবং তাঁর বহু মতের অনুসরণ করতেন। তিন তালাকের মাস্য়ালাতেও তিনি ইব্ন তাইমিয়ার মতানুযায়ী ফতওয়া দিতেন। এ কারণে তাঁকে এক ভীষণ অগ্নি পরীক্ষার সম্মুখীন হতে হয় এবং অন্তহীন নির্যাতন যাতনা ভোগ করতে হয়।
ইমাম ইব্ন কাসীর (রহঃ) রচিত গ্রন্থমালা -
১। আল্লামা হাফিয ইব্ন কাসীর তাঁর অমর স্মৃতির নিদর্শন হিসাবে এই মরজগতের বুকে যেসব মহামূল্য ধন-সম্পদ ও বিষয় বৈভব ছেড়ে গেছেন, তন্মধ্যে তাঁর লিখিত তাফসীরুল কুরআনিল আযীম যা তাফসীর ইব্ন কাসীর নামেই বেশি পরিচিত। পবিত্র কুরআনের এই সুপ্রসিদ্ধ ভাষ্য গ্রন্থ সম্পর্কে আল্লামা সুয়ূতী (রহঃ) বলেন
      এ ধরনের অন্য কোন তাফসীর লিপিবদ্ধই হয়নি।
কায়রোর প্রখ্যাত আলেম যাহিদ ইব্ন হাসান আল-কাউসারী আল্লামা জালালুদ্দীন সুয়ূতীর বরাতে বলেন- ـ
রিওয়ায়েতের বিশিষ্ট তাফসীরসমূহের মধ্যে এটি হচ্ছে সবচেয়ে কল্যাণপ্রদ ও উপকারী
২। আত্তাকমিলাহ ফী মারিফাতিস সিকাত ওয়াযযুআফায়ে ওয়াল মাজাহীল হাজী খলীফা মোল্লা কাতিব চালপী তাঁর অমর গ্রন্থ কাশফুয যুনূনেএই গ্রন্থখানির আত্ তাকমিলাহ্ ফী আসমাইস সিকাত ওয়ায্-যুআফা বলে উল্লেখ করেছেন। কিন্তু স্বয়ং গ্রন্থকার তাঁর আল বিদায়াহ ওয়ান নিহায়াহগ্রন্থে এবং ইখতিসারু উলূমিল হাদীসনামক অনবদ্য পুস্তকে উপরোক্ত নামেই উল্লেখ করেছেন।
গ্রন্থটির নাম থেকেই তার আলোচ্য বিষয়বস্তু সম্পর্কে একটা স্বচ্ছ ও সুস্পষ্ট ধারণা জন্মে। এটি রিজাল শাস্ত্রের (চরিত-অভিধান শাস্ত্র বা রাবীদের জীবনী সংগ্রহ বিজ্ঞান) একখানি নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ। আল্লামা হুসাইনীদিমাশকীর আলোচনা মতে এই আলোচ্য গ্রন্থ পাঁচ খণ্ডে সমাপ্ত হয়েছে। লেখক এতে হাফিয জামাল ইউসুফ ইব্ন আবদুর রাহমান মিয্যীর তাহযীবুল কামালএবং হাফিয শামসুদ্দীন যাহাবীর মীযানুল ইতিদালনামক চমৎকার গ্রন্থদ্বয়কে একত্রিত করেছেন। শুধু তাই নয়, নিজের পক্ষ থেকে বহু মূল্যবান তথ্য সংযোজন করে বেশ পরিবর্ধিত আকারে প্রকাশ করেন। গ্রন্থকার স্বয়ং অভিমত প্রকাশ করতে গিয়ে বলেন -
আলোচ্য গ্রন্থখানি বিশেষ অভিজ্ঞতা সম্পন্ন শাস্ত্রবিদের জন্য যেমন লাভজনক, ঠিক তেমনি মুহাদ্দিসের পক্ষেও উপকারী।
৩। আল বিদায়া ওয়ান-নিহায়া ইব্ন কাসীর রচিত ইতিহাস বিষয়ক ১৪ খন্ডের এই বিরাট গ্রন্থখানি তাঁর এক অনবদ্য সৃষ্টি। মিসর থেকে একাধিকবার এটি মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে। এতে সৃষ্টির প্রাথমিককাল থেকে শুরু করে শেষ যুগ পর্যন্ত সমস্ত ঘটনা ও অবস্থার কথা সুন্দরভাবে সবিস্তারে বিধৃত হয়েছে। প্রথমে নাবী-রাসূলগণ ও পরে প্রাচীন জাতির তথা বিগত উম্মাতদের বিস্তারিত বিবরণ এবং শেষে সীরাতে নবভীর বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে। তারপর খিলাফাতে রাশেদা থেকে শুরু করে একেবারে গ্রন্থকারের সময়কাল পর্যন্ত বিস্তৃত ঐতিহাসিক তত্ত্ব ও তথ্যাবলী সুন্দর ও স্বার্থকভাবে বর্ণিত হয়েছে। আর সেই সঙ্গে বিধৃত হয়েছে এই পৃথিবীর লয়প্রাপ্তি তথা রোয কিয়ামাতের আলামতসমূহ এবং আখিরাত বা পরজগতের অবস্থার কথাও ব্যাপক ও বিস্তারিতভাবে বর্ণিত হয়েছে। হাজী খলীফা তাঁর সুপ্রসিদ্ধ কাশফুয্ যুনূনগ্রন্থে বলেন-
       আল্লামা হাফিয ইব্ন কাসীর তাঁর অবধারিত মৃত্যুর দুই বছর পূর্ব পর্যন্ত সংঘটিত সমস্ত ঘটনাবলীকে সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। বিশেষ করে এতে সীরাতুন্নাবী অংশকে বেশ চমৎকার ও সার্থকভাবে উপস্থাপিত করা হয়েছে।
৪। আল-হাদয়ু ওয়াসসুনান ফী আহাদিসিল মাসানীদে ওয়াস সুনানএই গ্রন্থখানি জামিউল
মাসানীদনামেও প্রসিদ্ধ। এতে মুসনাদ আহমাদ ইব্ন হাম্বাল’, ‘মুসনাদ বায্যার, ‘মুসনাদ আবূ ইয়ালা’, ‘মুসনাদ ইব্ন আবী শাইবাএবং সাহিহায়িন এবং সুনান চতুষ্টয়ের রিওয়ায়াতগুলিকে একত্র করে বিভিন্ন অধ্যায় ও পরিচ্ছেদে সুন্দরভাবে বিন্যস্ত করা হয়েছে।
৫।  তাবাকাতুশ শাফিঈয়াহ এই গ্রন্থে শাফিঈ ফকীহদের বিস্তারিত বিবরণ প্রদত্ত হয়েছে।
৬।শারহু সাহীহিল বুখারীগ্রন্থকার ইব্ন কাসীর বুখারীর এই ভাষ্যটি লিখতে শুরু করেছিলেন এবং এ কাজে বেশ কিছুদূর তিনি অগ্রসর হয়েছিলেন। কিন্তু দুঃখের বিষয় তাসম্পূর্ণ করতে
পারেননি।
৭। আল-আহ্কামুল কাবীর এ গ্রন্থখানিতে তিনি শুধুমাত্র আহ্কাম বা অনুশাসন সম্পর্কিত হাদীসগুলিকে বিশদভাবে লিপিবদ্ধ করতে শুরু করেছিলেন। কিন্তু কিতাবুল হাজ্জপর্যন্ত পৌঁছে আর বেশীদূর অগ্রসর হতে পারেননি।
৮। ইখতিসারু উলূমিল হাদীস আল্লামা নওয়াব সিদ্দীক হাসান খাঁ ভূপালী তাঁর মিনহাযুল ঊসূল ফী ইসতিলাহি আহাদীর্সি রাসূলগ্রন্থে এর নাম আল বাইসুল হাদীস আলা মারিফাতে উলূমিল হাদীসবলে উল্লেখ করেছেন। এটি আল্লামা ইব্নস সালাহ (মৃত্যু ৬৪৩ হিজরী) লিখিত সুপ্রসিদ্ধ উসূলুল হাদীসের কিতাব উলূমিল হাসীসওরফে মুকাদ্দিমা ইব্নুস সালাহগ্রন্থের সংক্ষিপ্তসার। গ্রন্থকার ইব্ন কাসীর এর স্থানে স্থানে বহু সুন্দর জ্ঞাতব্য বিষয় বিশদভাবে সংযোজন করেছেন।

৯। মুসনাদুস শাইখাইন এতে আবূ বাকর (রাঃ) এবং উমার (রাঃ) থেকে বর্ণিত হাদীসসমূহ সংগৃহীত হয়েছে। গ্রন্থকার ইব্ন কাসীর (রহঃ) তাঁর ইখতিসারু উলূমিল হাদীসগ্রন্থে আর একখানি মুসনাদে উমরনামক গ্রন্থের কথা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু এটা একটা স্বতন্ত্র গ্রন্থ, না কি উপরিউক্ত গ্রন্থেরই দ্বিতীয় খণ্ড তা সঠিকভাবে জানা যায়না।
১০।  আসসীরাতুন নাবভীয়াহ এ একখানি বৃহদাকার উৎকৃষ্ট সীরাত গ্রন্থ।
১১। তাখরীজু আহাদীসি আদিল্লাত তামবীহ
১২।  মুখতাসার কিতাবুল মাদখাল লিল ইমাম বাইহাকী এই গ্রন্থের নাম গ্রন্থকার স্বয়ং ইখতিসারু উলূমিল হাদীসএর ভূমিকায় উল্লেখ করেছেন। এটি ইমাম আহমাদ ইব্ন হুসাইন আল বাইহাকী (৪৫৮ হিজরী) কৃত কিতাবুল মাদখালেরসংক্ষিপ্ত সার।
১৩।  রিসালাতুল ইজতিহাদ ফী তালাবিল জিহাদ খৃষ্টানরা যখন আয়াসদূর্গ অবরোধ করে সেই সময়ে তিনি এই পুস্তিকাখানি আমীর মনজাকের উদ্দেশে লিপিবদ্ধ করেছিলেন। এটি মিসর থেকে মুদ্রিত ও প্রকাশিত হয়েছে।
মোট কথা, তার লিখিত পবিত্র কুরআনের তাফসীর, হাদীসে রাসূল (সঃ), সীরাতুন্নবী (সঃ), ইতিহাস, ফিক্হ শাস্ত্র ইত্যাদি সম্বন্ধীয় গ্রন্থাবলী আজও বেশ জনপ্রিয়, সবার কাছে বিশেষ সমাদৃত ও দলমত নির্বিশেষে গ্রহণীয়। প্রায় সকল যুগের ঐতিহাসিকবৃন্দ ও তাফসীরকারগণ তাঁর ইতিহাস ও তাফসীর সম্বন্ধীয় এবং অন্যান্য গ্রন্থাবলীর প্রভূত প্রশংসা করেন।
ইব্ন কাসীরের মৃত্যু
অবধারিত মৃত্যুর আগে এই নশ্বর জীবনের শেষভাগে হাফিয ইব্ন কাসীর দৃষ্টিহীন হয়ে পড়েন। অতঃপর ১৩৭২ খৃষ্টাব্দ মুতাবিক ৭৭৪ হিজরীর ২৬ শাবান রোজ বৃহস্পতিবার এই মহামনীষী অস্থায়ী দুনিয়ার বুক থেকে বিদায় নিয়ে আখিরাতের সেই অনন্তলোকে যাত্রা করেন। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।

Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url