কিভাবে কুরআনের তাফসীর করতে হবে


কিভাবে কুরআনের তাফসীর করতে হবে

তাফসীরের ব্যাপারে উত্তম ও সঠিক নিয়ম এই যে, কুরআনের তাফসীর কুরআন দ্বারাই হবে। কারণ কুরআন মাজীদের বর্ণনা এক স্থানে সংক্ষিপ্ত হলেও অন্য স্থানে তার বিস্তারিত বর্ণনা ও ব্যাখ্যাও রয়েছে। তারপর কোন অসুবিধার ক্ষেত্রে কুরআনের তাফসীর সাধারণতঃ হাদীস দ্বারাই হয়ে থাকে। কারণ হাদীস কুরআন কারীমেরই ব্যাখ্যা ও তাফসীর। বরং ইমাম আবদুল্লাহ্ ইব্ন মুহাম্মাদ ইদরীস শাফিঈ (রহঃ) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সমস্ত নির্দেশ প্রদান করেন কুরআন মাজীদ থেকেই অনুধাবন করার পর।
আল্লাহ তাআলা বলেন :
إِنَّا أَنزَلْنَا إِلَيْكَ الْكِتَابَ بِالْحَقِّ لِتَحْكُمَ بَيْنَ النَّاسِ بِمَا أَرَاكَ اللّهُ وَلاَ تَكُن لِّلْخَآئِنِينَ خَصِيمًا
নিশ্চয়ই আমি তোমার প্রতি সত্যসহ গ্রন্থ অবতীর্ণ করেছি, যেন তুমি তদনুযায়ী মানুষদেরকে আদেশ প্রদান কর, যা আল্লাহ তোমাকে শিক্ষা দিয়েছেন এবং তুমি বিশ্বাসঘাতকদের পক্ষে বিতর্ককারী হয়োনা। (সূরা নিসা, : ১০৫)

আরও এক জায়গায় ইরশাদ হচ্ছে :
وَمَا أَنزَلْنَا عَلَيْكَ الْكِتَابَ إِلاَّ لِتُبَيِّنَ لَهُمُ الَّذِي اخْتَلَفُواْ فِيهِ وَهُدًى وَرَحْمَةً لِّقَوْمٍ يُؤْمِنُونَ
আমি তো তোমার প্রতি এই কিতাব অবতীর্ণ করেছি যারা এ বিষয়ে মতভেদ করে তাদেরকে সুস্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য এবং মুমিনদের জন্য পথনির্দেশ ও দয়া স্বরূপ।  (সূরা নাহল, ১৬ : ৬৪)

অন্য একস্থানে আল্লাহ সুবহানাহু ওয়া তাআলা বলেন :

وَأَنزَلْنَا إِلَيْكَ الذِّكْرَ لِتُبَيِّنَ لِلنَّاسِ مَا نُزِّلَ إِلَيْهِمْ وَلَعَلَّهُمْ يَتَفَكَّرُونَ
তাদের প্রেরণ করেছিলাম স্পষ্ট নিদর্শন ও গ্রন্থসহ এবং তোমার প্রতি কুরআন অবতীর্ণ করেছি মানুষকে স্পষ্টভাবে বুঝিয়ে দেয়ার জন্য, যা তাদের প্রতি অবতীর্ণ করা হয়েছিল, যাতে তারা চিন্তা ভাবনা করে। (সূরা নাহল, ১৬ : ৪৪)

রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
আমাকে কুরআন কারীম দেয়া হয়েছে এবং তার সঙ্গে তারই মত আরও একটি জিনিস দেয়া হয়েছে। (আহমাদ ৪/১৩১)

এর ভাবার্থ হচ্ছে সুন্নাত। এ কথা স্মরণ রাখা উচিত যে, হাদীসসমূহও আল্লাহরই প্রত্যাদেশ। কুরআন মাজীদ যেমন ওয়াহীর মাধ্যমে অবতীর্ণ হয়েছে তেমনি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের হাদীসও আল্লাহর অবতীর্ণ বাণী। কিন্তু কুরআন ওয়াহী মাতলুএবং হাদীসসমূহ ওয়াহী গায়ের মাতলু

সুতরাং এরই উপর ভিত্তি করে যখন কোন আয়াতের তাফসীর কুরআন ও হাদীসের মধ্যে পাওয়া না যাবে তখন সাহাবীগণের (রাঃ) কথার দিকে ফিরে যাওয়া উচিত।

সাহাবীগণ কুরআনের তাফসীর খুব ভাল জানতেন, কারণ যে ইঙ্গিত ও অবস্থা তখন ছিল তার সম্যক জ্ঞান তাঁদের থাকতে পারে যাঁরা সেই সময়ে স্বশরীরে বিদ্যমান ছিলেন। তাছাড়া পূর্ণ বিবেক, বিশুদ্ধ জ্ঞান এবং সৎ আমল তাঁরাই লাভ করেছিলেন।

বিশেষ করে ঐ সব মহামানব যাঁরা তাঁদের মধ্যেও বড় মর্যাদাসম্পন্ন এবং বিদগ্ধ আলেম ও চিন্তাবিদ ছিলেন, যেমন চারজন খলীফা যাঁরা অত্যন্ত সৎ ও হিদায়াত প্রাপ্ত ছিলেন, অর্থাৎ আবূ বাকর (রাঃ), উমার (রাঃ), উসমান (রাঃ), আলী (রাঃ) এবং যেমন আবদুল্লাহ্ ইব্ন মাসউদ (রাঃ)

আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) হতে বর্ণিত, তিনি বলেছেন : সেই আল্লাহর শপথ, যিনি ছাড়া অন্য কোন উপাস্য নেই, আল্লাহর কিতাবের এমন কোন আয়াত নেই যার সম্পর্কে আমার ভালরকম জানা নেই যে, তা কি ব্যাপারে অবতীর্ণ হয়েছিল এবং কোথায় অবতীর্ণ হয়েছিল।
যদি আমি জানতাম যে, আল্লাহর এই পবিত্র কিতাবের জ্ঞান আমার চেয়ে আর কারও বেশি আছে এবং সেখানে কোনও প্রকারে পৌঁছা সম্ভব হয় তাহলে অবশ্যই তাঁর কাছে হাযির হয়ে তাঁর অনুগত বাধ্য ছাত্র হিসাবে আমি নিজেকে পেশ করতাম।

এ ছাড়া আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) তাঁদেরই মধ্যে কুরআনের একজন বিশেষজ্ঞ ও বিদগ্ধ পণ্ডিত ছিলেন। তিনি ছিলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামের চাচাতো ভাই এবং কুরআন মাজীদের একজন প্রথিতযশা ব্যাখ্যাতা। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম স্বয়ং তাঁর জ্ঞানের প্রাচুর্যের জন্য আল্লাহর দরবারে প্রার্থনা জানিয়ে বলেছিলেন :
হে আল্লাহ! আপনি তাকে ধর্মের প্রকৃত প্রজ্ঞা দান করুন এবং পবিত্র কুরআনের তাফসীরেরও জ্ঞান দান করুন। (ফাতহুল বারী ১/২০৫)

আবদুল্লাহ ইব্ন মাসউদ (রাঃ) বলতেন : কুরআনের সর্বোত্তম ব্যাখ্যাকারী হলেন আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) (তাবারী ১/৯০)

আবদুল্লাহ ইব্ন মাসঊদের (রাঃ) এই কথাকে সামনে রেখে চিন্তা করুন যে, তাঁর মৃত্যু ঘটেছিল হিজরী ৩২ সনে, আর আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) তাঁর পরেও সুদীর্ঘ ৩৬ বছর জীবিত ছিলেন, তাহলে সেই সুদীর্ঘ সময়ের মধ্যে তিনি ধর্মীয় জ্ঞানে কত না উন্নতি লাভ করে থাকবেন! আবূ অয়েল (রহঃ) বলেন : আলীর (রাঃ) যুগে আবদুল্লাহ্ ইব্ন আব্বাস (রাঃ) হাজ্জের দলপতি নিযুক্ত হয়েছিলেন। তিনি ভাষণে সূরা বাকারাহ পাঠ করেন এবং এমন সুন্দরভাবে তাফসীর করেন যে, যদি তুরস্ক, রোম ও দহিলামের কাফিররা তা শুনত তাহলে তারাও তৎক্ষণাৎ বিনা বাক্যে মুসলিম হয়ে যেত (তাবারী ১/৮১)

কোন কোন বর্ণনায় আছে যে, তিনি উক্ত ভাষণে সূরা নূরের তাফসীর করেছিলেন। এ কারণেই ইসমাঈল ইব্ন আবদুর রাহমান সুদ্দী কাবীর স্বীয় তাফসীরে ঐ দুই মহান ব্যক্তির অধিকাংশ তাফসীর নকল করে থাকেন। কিন্তু আহলে কিতাব থেকে এই সম্মানিত ব্যক্তি মাঝে মাঝে যে বর্ণনা নিয়ে থাকেন তাতেও তিনি ব্যক্ত করেন যে, বানী ইসরাঈল থেকে রেওয়ায়িত গ্রহণ করা বৈধ। সহীহ বুখারীতে আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রাঃ) হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
একটি আয়াত হলেও তোমরা তা আমার পক্ষ থেকে পৌঁছে দিবে। বানী ইসরাঈল হতে বর্ণনা নেয়ায়ও কোন দোষ নেই। ইচ্ছাপূবকর্ আমার পক্ষ হতে মিথ্যা কথা প্রচারকারী সরাসরি জাহান্নামী।

ইয়ারমুকের যুদ্ধে আবদুল্লাহ ইব্ন আমর (রাঃ) ইয়াহুদী-খৃষ্টানদের কিতাবদ্বয়ের দুটি পাণ্ডলিপি পেয়েছিলেন। এই হাদীসটিকে লক্ষ্যবস্তু করে ঐ পুস্তকদ্বয়ের কথাগুলোকেও তিনি নকল করতেন।

ইসরাঈলী বর্ণনা ও কিচ্ছা-কাহিনী

স্মরণ রাখা দরকার যে, বানী ইসরাঈলের বর্ণনাগুলো শুধুমাত্র ধর্মীয় নীতির পৃষ্ঠপোষকতায় গ্রহণ করা যায়, তা থেকে ধর্মীয় নীতি সাব্যস্ত হতে পারেনা। বানী ইসরাঈলের বর্ণনাগুলি তিন ভাগে বিভক্ত :
(১) যেগুলির সত্যতা স্বয়ং আমাদের এখানেই বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ যদি পবিত্র কুরআনের কোন আয়াত বা হাদীসের অনুরূপ কোন বর্ণনা বানী ইসরাঈলের কিতাবেও পাওয়া, তার সত্যতায় কোন মতবিরোধ নেই।

(২) যেগুলো মিথ্যা হওয়ার প্রমাণ আমাদের নিকটেই বিদ্যমান রয়েছে। অর্থাৎ ওটা কোন আয়াত বা হাদীসের উল্টো। ওটা অসত্য হওয়ায় কোন সন্দেহ নেই।

(৩) যেগুলোকে আমরা না পারি মিথ্যা বলতে, আর না পারি সত্য বলতে। যেহেতু আমাদের নিকট এমন কোন বর্ণনা নেই যা অনুরূপ হওয়ার কারণে আমরা তাকে সঠিক বলতে পারি বা এমন কোন বর্ণনা নেই যার উপর ভিত্তি করে আমরা ওকে মিথ্যা বা ভুল বলতে পারি।
এই বর্ণনাগুলোও এরূপ যে, ওতে আমাদের ধর্মের কোন উপকার নেই। যেমন গুহাবাসীগণের নাম, ইবরাহীম (আঃ) যে পাখীগুলিকে খণ্ড খণ্ড করেছিলেন, অতঃপর আল্লাহর আদেশে ওরা জীবিত হয়েছিল ঐ পাখীগুলির নাম কি ছিল, যে নিহত ব্যক্তিকে মূসার (আঃ) যুগে গাভী যবাহ করে ওর একটি গোশত খণ্ড দ্বারা আঘাত করা হয়েছিল এবং যার ফলে আল্লাহর আদেশে সে পুনর্জীবিত হয়েছিল, ওটা কোন্ খণ্ড ছিল এবং কোন্ জায়গায় ছিল, আর সেটি কোন্ বৃক্ষ ছিল যার উপর মূসা (আঃ) আলো দেখেছিলেন এবং যেখান থেকে আল্লাহর কথা শুনেছিলেন ইত্যাদি।
সুতরাং ওগুলি এমনই জিনিস যার উপর আল্লাহ তাআলা যবনিকা নিক্ষেপ করেছেন, আর ঐগুলো জানায় বা না জানায় কোন লাভ বা ক্ষতি সম্পর্কে আমরা অজ্ঞাত রয়েছি এবং তাতে নিয়োজিত থাকলে ইহলৌকিক বা পারলৌকিক কোন উপকারও নেই।

তাবেঈগণের তাফসীর প্রসঙ্গ

কোন আয়াতের তাফসীর কুরআন, হাদীস এবং সাহাবীবৃন্দের কথার মধ্যে পাওয়া না গেলে ধর্মীয় ইমামগণের অধিকাংশের অভিমত এই যে, এরূপ স্থলে তাবেঈগণের তাফসীর নেয়া হবে। যেমন মুজাহিদ ইব্ন জাবর (রহঃ) যিনি তাফসীরের ব্যাপারে আল্লাহর একটি নিদর্শন ছিলেন। তিনি স্বয়ং বলেন : আমি তিনবার প্রথম হতে শেষ পর্যন্ত পবিত্র কুরআন আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) নিকট শিখেছি ও বুঝেছি। একটি আয়াতকে জিজ্ঞেস করে করে এবং বুঝে বুঝে পড়েছি।

ইমাম ইব্ন জারির বর্ণনা করেন, ইব্ন আবী মুলাইকাহ (রহঃ) বলেন : আমি স্বয়ং মুজাহিদকে (রহঃ) দেখেছি যে, তিনি কিতাব, কলম নিয়ে ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) নিকট যেতেন এবং কুরআনের তাফসীর জিজ্ঞেস করে করে তাতে নিরন্তর লিপিবদ্ধ করতেন। তিনি এভাবেই সম্পূর্ণ কুরআনের তাফসীর নকল করেন। সুফইয়ান শাউরী (রহঃ) বলতেন যে, মুজাহিদ (রহঃ) কোন আয়াতের তাফসীর করে দিলে তার সত্যাসত্য যাচাই করা বাহুল্য মাত্র।
তার তাফসীরই যথেষ্ট। মুজাহিদের (রহঃ) মত সাঈদ ইব্ন যুবাইর (রহঃ), আবদুল্লাহ ইব্ন আব্বাসের (রাঃ) ক্রীতদাস ইকরিমাহ (রহঃ), ‘আতা ইব্ন আবী রাবাহ্ (রহঃ), হাসান বাসরী (রহঃ), মাসরুক ইব্ন আজদা (রহঃ), সাঈদ ইবনুল মুসাইয়াব (রহঃ), যাহ্হাক (রহঃ) প্রভৃতি তাবেঈ ও তাবেতাবেঈগণের এবং তাঁদের পরবর্তী যুগের তাফসীর বিশ্বাসযোগ্যরূপে গণ্য করা হবে।
কখনও এরূপও হয়ে থাকে যে, কোন আয়াতের তাফসীরের মধ্যে যখন ঐ সব আলেমগনের কথা বর্ণনা করা হয় এবং তাঁদের শব্দের মধ্যে বাহ্যত মতভেদ পরিলক্ষিত হয়, তখন বিদ্যাহীন ব্যক্তিরা সেটিকে মৌলিক মতভেদ মনে করে বলে থাকে যে, এই আয়াতের তাফসীরে মতভেদ রয়েছে।
অথচ প্রকৃতপক্ষে এরূপ হয়না। বরং একটি জিনিসের ব্যাখ্যা কেহ হয়ত সংক্ষেপ করেছেন, কেহ হয়ত করেছেন ওর দৃষ্টান্তের দ্বারা, আবার কেহ হয়ত স্বয়ং ঐ জিনিসকেই বর্ণনা করেছেন। সুতরাং এমতাবস্থায় শব্দের মধ্যে মতভেদ সৃষ্টি হলেও অর্থ একই থাকে। এসব স্থলে জ্ঞানীদের সন্দেহে পতিত না হওয়াই উচিত। আল্লাহই সবার জন্য সঠিক পথের পরিচালক।

কারও মতামতের উপর ভিত্তি করে তাফসীর করা

শুধুমাত্র স্বীয় অভিমত দ্বারা তাফসীর করা সম্পূর্ণরূপে হারাম। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন :
যে ব্যক্তি কুরআনের মধ্যে স্বীয় মত ঢুকিয়ে দিল কিংবা না জেনে -শুনে কিছু বলে দিল, সে জাহান্নামের মধ্যে স্বীয় স্থান নির্দিষ্ট করে নিল। তিরমিযী, নাসাঈ এবং আবূ দাঊদে এই হাদীসটি রয়েছে এবং ইমাম তিরমিযী (রহঃ) হাদীসটিকে হাসান বলে আখ্যায়িত করেছেন।

জানা থাকলে বর্ণনা করতে হবে, অন্যথায় চুপ থাকতে হবে

এ কারণেই পূর্ব যুগের সালাফগণের একটি বড় দল না জেনে-শুনে তাফসীর করতে খুব ভয় করতেন, বরং তাঁদের সর্ব অবয়ব কেঁপে উঠত।

আবূ বাকর সিদ্দীকের (রাঃ) উক্তি আছে : যদি কুরআনের মধ্যে এমন কথা বলি যা আমার জানা নেই তাহলে কোন্ মাটি আমাকে উঠাবে ও কোন্ আকাশ আমাকে ছায়া দিবে?
একবার উমার ইব্ন খাত্তাব (রাঃ) وَفَاكِهَةً وَأَبًّا আয়াতটি পাঠ করেন।

অতঃপর বলেন :  فَاكِهَةً কে তো আমি জানি, কিন্তু এই أَبًّ কি জিনিস?’ তিনি নিজে নিজেই বলেন এই কষ্টের তোমার প্রয়োজন কি?’ ভাবার্থ এই যে,  এর অর্থ তো জানা আছে অর্থাৎ ভূমি হতে উৎপাদিত শস্য। কিন্ত ওর অবস্থা ও গুণ সম্পর্কে জানা নেই। স্বয়ং এই আয়াতেই বিদ্যমান রয়েছে, وَعِنَبًا وَقَضْبًا فَأَنبَتْنَا فِيهَا حَبًّا  আমি যমীনের মধ্য হতে ফসল এবং আঙ্গুর উৎপাদন করেছি। (সূরা আবাসা, ৮০ : ২৭-২৮)

তাফসীর-ই- ইব্ন জারীরে বিশুদ্ধ সনদের সঙ্গে বর্ণিত আছে যে, ইব্ন আবী মুলাইকাহ্ (রহঃ) বলেন : ইব্ন আব্বাসকে (রাঃ) কোন এক ব্যক্তি একটি আয়াতের তাফসীর জিজ্ঞেস করলে তিনি কিছুই বর্ণনা করলেননা। অথচ যদি ওর তাফসীর আপনাদের মধ্যে কোন লোককে জিজ্ঞেস করা হত তাহলে তিনি তৎক্ষণাৎ উত্তর দিয়ে দিতেন।

অন্য এক বর্ণনায় আছে যে, এক ব্যক্তি তাঁকে জিজ্ঞেস করল :
কুরআনুল হাকীমের মধ্যে এক হাজার বছরের সমান একটি দিন উল্লেখ আছে, ওটা কি? ইব্ন আব্বাস (রাঃ) জিজ্ঞেস করলেন : ঐ দিনটি হবে পৃথিবীর ৫০ হাজার বছরের সমান এর অর্থ কী? লোকটি বলল : আমি আপনাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করছি। ইব্ন আব্বাস (রাঃ) বললেন : আল্লাহ তাঁর কিতাবে এ ধরণের দুটি দিনের কথা উল্লেখ করেছেন এবং তিনিই এ ব্যাপারে জ্ঞান রাখেন।

যার কুরআনের কোন বিষয়ের জ্ঞান নেই সেই ব্যাপারে মন্তব্য করা আল্লাহ পছন্দ করেননা। আল-লাইস (রহঃ) ইয়াহইয়া ইব্ন সাঈদ (রহঃ) থেকে বর্ণনা করেন যে, সাঈদ ইব্ন মুসাইয়াব (রহঃ) কুরআন থেকে তার জানা বিভিন্ন বিষয়ে লোকদেরকে তালিম দিতেন। 

এ ছাড়া আইউব ইব্ন আউন (রহঃ) এবং হিসাম আদ-দাস্তআই (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, মুহাম্মাদ ইব্ন সীরীন (রহঃ) বলেছেন :
আমি উবাইদাহকে (আস-সালমানী) কুরআনের একটি আয়াত সম্পর্কে জিজ্ঞেস করলে তিনি বললেন : কুরআন নাযিলের বিভিন্ন প্রেক্ষাপট সম্পর্কে যারা জানতেন তারা তো দুনিয়া হতে বিদায় নিয়েছেন, সুতরাং আল্লাহকে ভয় কর এবং সঠিক পথের অনুসন্ধান কর।

শাবি (রহঃ) বর্ণনা করেন যে, মাসরুক (রহঃ) বলেছেন : তাফসীর করা থেকে সাবধান থেক, কারণ ইহা এমন বর্ণনা যার সাথে আল্লাহ তাআলা জড়িত আছেন। (তাবারী)

মুসলিম ইব্ন ইয়াসার (রহঃ) বলতেন : কুরআনের তাফসীর করার সময় তোমরা আগে পিছে দেখে নিও। কারণ এতে আল্লাহ তাআলার প্রতি পূর্ণ সম্বন্ধ রেখে কথা বলা হচ্ছে। মাসরুক (রহঃ) উক্তি করেন : তাফসীরের ব্যাপারে তোমরা অত্যন্ত সতর্কতা অবলম্বন কর, কেননা এতে স্বয়ং আল্লাহ তাআলা হতে বর্ণনা করা হয়। (তাবারী ১/৮৬)

এই সমুদয় উক্তি যা অতীতের মহান ব্যক্তিগণ হতে করা হয়েছে তাতে এ কথাই স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়ে উঠেছে যে, ঐ সমস্ত আলেম কখনও না জেনে কুরআনের ভাবার্থের ব্যাপারে মুখ খুলতেননা। এখন প্রশ্ন জাগতে পারে, ঐসব সম্মানিত জ্ঞানী ব্যক্তি যখন কুরআনের তাফসীরের ব্যাপারে সতর্কতা অবলম্বন করে তা হতে বিরত থাকতেন, তাহলে তাঁদের হতে তাফসীর কেন নকল করা হয়েছে? এর উত্তরে বলা যাবে যে, যা তাঁরা জানতেননা শুধু সেখানেই নীরব থাকতেন এবং যা জানতেন তা বর্ণনা করতেন।

সুতরাং না জানা অবস্থায় নীরবতা অবলম্বন করা এবং জ্ঞাত বিষয় প্রকাশ করাই সকলের উচিত। পবিত্র কুরআনে ঘোষিত হচ্ছে : لَتُبَيِّنُنَّهُ لِلنَّاسِ وَلاَ تَكْتُمُونَهُ
আর যখন যাদেরকে গ্রন্থ প্রদান করা হয়েছে তাদের কাছ থেকে আল্লাহ অঙ্গীকার গ্রহণ করেছিলেন, তারা নিশ্চয়ই এটি লোকদের মধ্যে ব্যক্ত করবে এবং তা গোপন করবেনা। (সূরা আলে ইমরান, : ১৮৭)

হাদীসে বর্ণিত আছে :
যাকে ধর্মনীতি সম্পর্কে কিছু জিজ্ঞেস করা হয় এবং সে তা জানা সত্ত্বেও গোপন করে, কিয়ামাতের দিন তাকে আগুনের লাগাম পরানো হবে। (আহমাদ, তিরমিযী ইত্যাদি)

টিকা
. ওয়াহী মাতলু কুরআন হাকীম যা সালাতে পাঠ করলে সালাত আদায় হয়ে থাকে। আর ওয়াহী গায়ের মাতুল হাদীসসমূহ যা সালাতে পাঠ করলে সালাত আদায় হয়না।



Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url