নবী কারীম (সা.) এর সুন্নাত, খোলাফায়ে রাসেদা এবং সাহাবা (রাযি.) এর অনুসরণ করা সম্পর্কে কিছু হাদীস । বিষয় ভিত্তিক হাদীস

রাসূলুল্লাহ (সা.) এর সুন্নাতের অনুসরণ সম্পর্কিত কিছু গুরুত্বপূর্ণ হাদীস

ইমাম বুখারী অপর এক রেওয়ায়েতে আবু হুরায়রা (রাযি.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, আমার প্রত্যেক উম্মত জান্নাতে প্রবেশ করবে, শুধু সেই ব্যক্তি ব্যতীত যে অস্বীকার করেছে। জিজ্ঞেস করা হলো অস্বীকার করেছে এমন ব্যক্তি কে? বললেন যে ব্যক্তি আমাকে মান্য করেছে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে আর যে আমাকে অমান্য করেছে সে অস্বীকার করেছে । (জামে)

ইমাম বুখারী হযরত জাবের (রাযি.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, নবী করীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ঘুমিয়ে ছিলেন এমন সময় কয়েকজন ফেরেশতা তাঁর নিকট আসলেন। তারা (পরস্পর) বললেন, তোমাদের এই সঙ্গী সম্পর্কে একটি উদাহরণ আছে। তোমরা তার সম্পর্কে একটি উদাহরণ পেশ কর। তাদের কেউ একজন বললেন, তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন। অপর একজন বললেন তাঁর চোখ, ঘুমন্ত কিন্তু দিল জাগ্রত। অতঃপর তারা বললেন তাঁর উদাহরণ এমন এক ব্যক্তি ন্যায় যে, একটি ঘর বানালো। এবং (খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুত করে) তার মধ্যে (খাবারের) দস্তরখান সাজালো ও একজনকে লোকদের ডাকতে পাঠালো। যে তাঁর ডাকে সাড়া দিল সে ঘরে প্রবেশ করল ও দস্তরখান থেকে খাবার গ্রহণ করল। আর যে তার ডাকে সাড়া দিল না সে ঘরে প্রবেশ করল না এবং দস্তরখান থেকে খাবারও গ্রহণ করল না। ফেরেশতাগণ পরস্পর বললেন, উদাহরণটি ব্যাখ্যা কর। যাতে তিনি বুঝতে পারেন। তাদের একজন বললেন তিনি তো ঘুমিয়ে আছেন অপরজন বললেন, তার চক্ষু ঘুমন্ত। কিন্তু দিল জাগ্রত। অতঃপর তারা বললেনঃ ঘর হল ‘জান্নাত’। আর যাকে ডাকতে পাঠানো হয়েছে তিনি হলেন ‘মুহাম্মদ’ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম)। অতএব যে ব্যাক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে মান্য করেছে সে আল্লাহকে মান্য করেছে। আর যে ব্যক্তি মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে অমান্য করেছে সে আল্লাহকে অমান্য করেছে। এবং মুহাম্মদ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম লোকদেরকে দুই ভাগে বিভক্ত করে দিয়েছেন। (অর্থাৎ একদল তাকে মা মেনে জান্নাতে গেল, আর অপর দল না মানার কারণে জাহান্নামে গেল) ইমাম বুখারী ও মুসলিম (রহ.) হযরত আবু মুসা (রাযি.) হতে বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেনঃ আমার এবং আমাকে যা কিছু দিয়ে আল্লাহ তা‘আলা পেরণ করেছেন তার উদাহরণ সে ব্যক্তির ন্যায়, যে তাঁর সম্প্রদায়ের নিকট এসে বলল- হে আমার সম্প্রদায়! আমি স্বচক্ষে বিপুল পরিমাণ শত্রু সৈন্য প্রত্যক্ষ করে এসেছি এবং আমি নিঃস্বার্থভাবে তোমাদেরকে সে বিষয়ে ভীতি প্রদর্শন করছি। সুতরাং তোমরা দ্রুত প্রাণরক্ষার পথ নির্ধারণ কর।
অতএব তার কথা সম্প্রদায়ের একদল লোক মেনে নিল এবং সন্ধ্যা বেলায় রাওয়ানা হয়ে গেল ও ধীরে সুস্থে পথ চলে তারা রক্ষা পেয়ে গেল।
অপর একদল তাঁকে মিথ্যাবাদী মনে করলো ও স্বস্থানে রয়ে গেল। সকাল হতেই শত্রু সৈন্য তাদের উপর আক্রমণ করল এবং তাদেরকে ধ্বংস করল ও সমূলে বিনাশ করে দিল।
এটি সেই দু ব্যক্তির উদাহরণ প্রথমত যে আমাকে মান্য করল এবং আমি যা নিয়ে এসেছি তার অনুসরণ করল। দ্বিতীয়- সে ব্যক্তির উদাহরণ যে আমাকে মান্য করল না এবং আমি যে দ্বীনে হক নিয়ে এসেছি তাকে মিথ্যা মনে করল।


হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আমর (রাযি.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ বনি ইসরাইলের মধ্যে যা কিছু ঘটেছে আমার উম্মতের মধ্যেও অবশ্যই তা ঘটবে। (আমার উম্মতের অবস্থা তাদের তাদের সাথে এমন সামঞ্জস্য পূর্ণ হবে) যেমন জুতার জোড়া তৈরি করতে সামাঞ্জস্যতা রক্ষা করা হয়। এমন কি যদি তাদেরকে মধ্যে কেউ আপন মায়ের সাথে প্রকাশ্যে ব্যবিচার করে থাকে তবে আমার উম্মতের মধ্যেও এমন লোক হবে যে এরূপ কাজ করবে।
বনি ইসরাইল বাহাত্তর দলে বিভক্ত হয়েছিল আর আমার উম্মত ৭৩ দলে বিভক্ত হবে। তন্মধ্যে একদল ব্যতিত সকলেই জাহান্নামে যাবে।
সাহাবারা জিজ্ঞেস করলেন, হে আল্লাহর রাসূল! সেই এক দল কারা? তিনি বললেন- যারা সে আদর্শের উপর অবিচল থাকবে যে আদর্শের উপর আমি ও আমার সাহাবারা রয়েছে। (তিরমীজী)


হযরত ইরবায ইবনে সারিয়া (রাযি.) হতে বর্ণিত আছে যে, তিনি বলেছেন একদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম নামাজ পড়ে আমাদের দিকে ফিরলেন এবং আমাদেরকে এমন মর্মস্পর্শী ওয়াজ করলেন যাতে চক্ষু অশ্রুসিক্ত হল ও দিল কম্পিত হল। এক ব্যক্তি বলল ইয়া রাসূলাল্লাহ! এ তো বিদায় গ্রহণকারীর শেষ নসিহতের ন্যায় মনে হচ্ছে। কাজেই আপনি আমাদেরকে কোন্ কাজ বিশেষ ভাবে করতে বলেন?
তিনি বললেন- আমি তোমাদেরকে এই ওসিয়ত করছি যে, তোমরা আল্লাহকে ভয় করবে, আমীরের কথা শুনবে ও মেনে চলবে। যদিও আমীর একজন হাবশী গোলাম হয়।
আর তোমাদের মধ্যে যে কেউ আমার পর জীবিত থাকবে সে (লোকদের মধ্যে) অনেক মতবিরোধ দেখতে পাবে। তখন তোমরা আমার ও আমার হেদায়েত প্রাপ্ত খোলাফায়ে রাশেদীনের আদর্শের উপর অবিচল থাকবে। উহাকে দৃঢ় ভাবে আঁকড়ে ধরবে এবং দাঁতে কামড়ে ধরে থাকবে।
মনগড়া বিষয় হতে দূরে থাকবে কারণ প্রত্যেক মনগড়া বিষয় বিদআত। আর প্রত্যেক বিদআতই গোমরাহী।

হযরত বেলাল ইবনে হারেস মুযানী (রাযি.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন যে কেউ আমার নিকট সুন্নাত হতে এমন কোন সুন্নাত প্রতিষ্ঠা করবে যা আমার পর বিলুপ্ত হয়ে গিয়েছিল। সে ঐ সকল লোকদের সমপরিমাণ সওয়াব পাবে যারা ঐ সুন্নাতের উপর আমল করে গিয়েছে যারা তার উপর আমল করেছে। এবং এতে আমল কারীদের সওয়াব কোন প্রকার কম হবে না।
আর কেউ এমন কোন গোমরাহীর পদ্ধতি চালু করবে যার উপর আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (সা. )সন্তুষ্ট নন, তবে সে ঐ সকল লোকদের সমপরিমাণ গুনাহের ভাগিদার হবে যারা এ গোমরাহীর উপর আমল করেছে এবং এতে আমল কারীদের গুনাহও কোন প্রকার কম হবে না। (তিরমীযী)


হযরত আমর ইবনে আউফ (রাযি.) বর্ণনা করেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ দ্বীন হেজাযের দিকে এমনভাবে গুটিয়ে আসবে, যেমন সাপ তার গর্তের দিকে গুটিয়ে আসে। আর দ্বীন হেজাজের ভেতর এমন ভাবে তার আশ্রয় তৈরি করে নেবে যেমন পাহাড়ি বকরী (বাঘের ভয়ে) পাহাড়ের চূড়ায় তার আশ্রয় বানিয়ে নেয়।
আর দ্বীন (যেমন) প্রথমাবস্থায় অপরিচিত ছিল, পুনরায় প্রথম অবস্থার মত অপরিচিত হয়ে যাবে।
সুসংবাদ তাদের জন্য যারা (দ্বীনের কারণে লোকদের মধ্যে) অপরিচিত হয়ে যাবে।
আর তারা ঐ সকল লোক হবে যারা আমার সেই সুন্নাতকে সংশোধন করে দেয়, যা আমার পর লোকেরা নষ্ট করে দিয়েছে। (তিরমীয়ী) 


হযরত আনাস (রাযি.) বলেন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাকে বললেনঃ হে আমার সন্তান! যদি পারো সকাল সন্ধ্যা (অর্থাৎ সারাক্ষণ) এমন ভাবে কাটাও যেন তোমার অন্তরে কারো প্রতি হিংসা বিদ্বেষ না থাকে, এরপর বললেন এটি আমার সুন্নাত। যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে ভালবাসল, সে আমাকে ভালবাসল এবং যে আমাকে ভালবাসল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে। (তিরমিজি)

হযরত ইবনে আব্বাস (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ আমার উম্মত যখন (দ্বীন থেকে দূরে সরে যাওয়ার কারণে) নষ্ট হয়ে যাবে, তখন যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারন করবে সে এক শত শহীদের সওয়াব পাবে। (বাইহাকী)

হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) হতে তাবারানী ও আবু নুয়াঈম বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, আমার উম্মত যখন নষ্ট হয়ে যাবে তখন আমার সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারনকারী একজন শহীদের সওয়াব পাবে ।
হাকিম তিরমিজি (রহ.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, আমার উম্মতের মতানৈক্যের সময় আমার সুন্নতকে দৃঢ়ভাবে ধারণকারীর দৃষ্টান্ত সে ব্যক্তির ন্যায় যে জলন্ত কয়লা হাতে ধারণ করেছে। (কানয)

হযরত আনাস (রাযি.) বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সুন্নাত হতে মুখ ফিরিয়ে নেবে সে আমার দলভুক্ত নয়। এ হাদীসের প্রথমাংশে এরূপ বর্ণিত হয়েছে যে, যে ব্যক্তি আমার সুন্নতের উপর আমল করবে সে আমার দলভুক্ত। (মুসলিম, ইবনে আসাকির)
হযরত আয়েশা (রাযি.) হতে দারাকুতনি বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি সুন্নাত কে মজবুত করে ধরবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে।
হযরত আনাস (রাযি.) হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ যে ব্যক্তি আমার সুন্নতকে প্রতিষ্ঠিত করল সে আমাকে ভালবাসল আর যে আমাকে ভালবাসল সে আমার সাথে জান্নাতে থাকবে।

খোলাফয়ে রাশেদা ও সাহাবায়ে কেরাম (রাযি.) এর মর্যাদা ও আদর্শ অনুসরণ সম্পর্কিত হাদীস

ইমাম বোখারী হতে বর্ণিত রেওয়ায়েতে আছে যে, হযরত আবু হুরায়রা (রাযি.) বলেছেন যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইরশাদ করেছেনঃ যে আমাকে মান্য করল সে আল্লাহকে মান্য করল, যে আমাকে অমান্য করল সে আল্লাহকে অমান্য করল। এবং যে আমার নিযুক্ত আমীরকে অমান্য করল সে আমাকে অমান্য করল।
হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু হতে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমি আমার পরওয়ারদেগারের নিকট আমার পর আমার সাহাবীদের পরস্পর মতবিরোধ সম্পর্কে জিজ্ঞেস করেছি। তিনি আমাকে ওহীর মাধ্যমে বলেছেন, “হে মুহাম্মদ! তোমার সাহাবীগণ আমার নিকট আকাশের নক্ষত্র তুল্য। যদিও তাদের মধ্যে কোনটির আলো অন্যটির তুলনায় অধিক হয়ে থাকে। তবু প্রত্যেকটার মধ্যে আলো রয়েছে। সুতরাং যদি তাদের কোন বিষয়ে মতানৈক্য হয় তবে যে কেউ তাদের যে কোন মত অবলম্বন করে চলবে, সে আমার নিকট হেদায়েত প্রাপ্ত বলে গণ্য হবে। আর রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন আমার সাহাবীগণ নক্ষত্রতুল্য। তোমরা তাদের যাকে অনুসরণ করবে হেদায়েত প্রাপ্ত হবে। (জামউল ফাওয়াইদ)
হযরত হুযাইফা রাদিয়াল্লাহু বর্ণনা করেছেন যে, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেনঃ জানিনা আমি তোমাদের মাঝে কত দিন জীবিত থাকব? অতঃপর আবু বকর ও হযরত ওমর রাদিয়াল্লাহু এর প্রতি ইঙ্গিত করে বললেন তোমরা আমার পর এ দুজনের অনুসরণ করবে। আম্মাররের চরিত্র অবলম্বন করবে ও ইবনে মাসউদ (রাযি.) যা কিছু বর্ণনা করেন তা সত্য জানবে। (তিরমীযী)
উৎস: হায়াতুস সাহাবা, সম্পাদনা: ইসলামঅলসো.কম
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url