শানে নুযুল কি? শানে নুযূল এর গুরুত্ব ও উপকারিতা

শানে নুযুল কি?

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন তার প্রিয় সৃষ্টি মানব জাতির ইহ-পরকালীন কল্যাণ ও সাফল্যের চূড়ান্ত নির্দেশিকা হিসেবে যে মহাগ্রন্থ নাযিল করেছেন, সেই আল কুরআনুল কারীম মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের উপর একসাথে অবতীর্ণ হয়নি। প্রায় ২৩ বছর ধরে এই গ্রন্থ নাযিল হয়েছে। আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে হযরত জিবরাঈল আলাইহিস সালাম কোরআনের আয়াত নিয়ে আগমন করতেন।
কোরআনুল কারিমের আয়াত দু প্রকার। প্রথমতঃ সেসব আয়াত যা আল্লাহ পাক কোন উপলক্ষ কিংবা কারো প্রশ্ন ছাড়াই নাযিল করেছেন। দ্বিতীয়তঃ এমন সব আয়াত যেগুলো কোন বিশেষ কিংবা কোনো প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে নাজিল হয়েছে।
মুফাস্সিরীনে কিরাম দ্বিতীয় প্রকার আয়াত অবতরণের পটভূমিকে আসবাবে নুযুল বা শানে নুযুল বলে আখ্যা দিয়েছেন।
যেমন সূরা বাকারার আয়াত;
“মুশরিক নারীদের বিবাহ করো না যতক্ষণ না তারা ঈমান আনয়ন করে। নিঃসন্দেহে মুমিনা বাদী মুশরিক নারী থেকে উত্তম। যদিও মুশরিক নারী তোমাদের পছন্দ হয়।”
এ আয়াত বিশেষ একটি ঘটনার কারনে নাযিল হয়। জাহেলী যুগে আনাক নাম্নী জৈনকা মহিলার সাথে হযরত মারছাদ ইবনে আবু মারছাদর সম্পর্ক ছিল।
ইসলাম গ্রহণের পর তিনি মদীনায় হিজরত করেন। আর আনাক মক্কায় থেকে যায়। হযরত মারছাদ একবার কোন কাজে মক্কা এলে ওই মহিলা তাকে কুপ্রস্তাব দেয়।
হযরত মারছাদ পরিষ্কার ভাষায় অস্বীকার করে বলেন; ইসলাম তোমার ও আমার মাঝে অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। অবশ্য তুমি চাইলে আমি রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামের অনুমতির পরে তোমাকে বিবাহ করতে পারি। তিনি কথামতো রাসূলে আকরাম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর কাছে বিবাহের অনুমতি চাইলে এ আয়াত নাজিল হয় এবং মুশরিক নারীর প্রতি নিষেধাজ্ঞা জারি হয়।

শানে নুযূল এর গুরুত্ব ও উপকারিতা

অনেকেই জ্ঞানের ও অগভীরতা ও অপরিপক্বতার কারনে শানে নুযূল এর গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। তারা বলেন কোরআন মাজীদ স্বয়ং এমন একখানা প্রাঞ্জল গ্রন্থ যে, এর ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ জানার জন্য শানে নুযুল এর কোন দরকার নেই। এদের এই ধারণা সম্পূর্ণ ভুল ও অসার।
মুসলিম মনীষীদের অভিমত অনুযায়ী শানে নুযুল ইলমে তাফসীরের একটি অপরিহার্য শর্ত। এর উপকারিতা অশেষ। এর কয়েকটি এখানে পেশ করা হলঃ
(১) আল্লামা যরকাশী বলেন, শানে নুযুল জানার প্রথম উপকার এই যে, এর দ্বারা শরয়ী বিধানের হেতু জানা যায়। বুঝা যায় আল্লাহ পাক কোন অবস্থায় কি প্রেক্ষাপটে কেন এ বিধান নাযিল করেছেন। যেমন, এরশাদ হয়েছে-
“হে ঈমানদারেরা! তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজের কাছে যেও না” (সূরা নিসা ৪৭৩)
যদি শানে নুযুল এর বিবরণ সামনে না থাকে তাহলে স্বাভাবিকভাবেই প্রশ্ন মনে উঁকি মারবে যে, কুআনের দৃষ্টিতে মদ যেহেতু হারাম সেহেতু এখন বলার দরকার কি যে, তোমরা মাতাল অবস্থায় নামাজ পড়ো না। এ প্রশ্নের জবাব পাওয়া যেতে পারে কেবল শানে নুযুল থেকে।
এর শানে নুযুল প্রসঙ্গে হযরত আলী রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, মদ হারাম হওয়ার পূর্বে একবার হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদিয়াল্লাহু আনহু কিছু সাহাবাকে খাবারের দাওয়াত দেন। সেখানে খাবার পর শরাব পান করা হয়। ইতোমধ্যে নামাজের ওয়াক্ত এসে যায়। এক সাহাবী ইমামতি করেন এবং নেশার কারণে কোরআনের আয়াত তেলাওয়াতে ভুল করেন। এ প্রসঙ্গে অত্র আয়াত নাযিল হয়। (ইবনে কাসির)
(২) অনেক সময় শানে নুযুল ছাড়া আয়াতের সঠিক মর্মোদ্ধার সম্ভব হয় না । যদি শানে নুযুল জানা না থাকে তাহলে ঐ আয়াত সম্পর্কে মানুষের ভুল মর্ম লাভের সম্ভাবনা থাকে অধিক। যেমন, “পূর্ব-পশ্চিম আল্লাহর-ই, সুতরাং যেদিকেই তোমরা মুখ ফেরাও সেদিকেই আল্লাহর মুখ রয়েছেন। (সূরা বাকারা -১১৫)
যদি এই আয়াতের শানে নুযুল জানা না থাকে তাহলে মনে হবে, নামাজের মধ্যে কেবলা মুখী হওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। পূর্ব-পশ্চিম সবদিকেই যখন আল্লাহ আছেন, তখন কেবলা মুখি হওয়ার দরকার কি? অথচ ধারণাটা সম্পূর্ণ ভুল। অন্য এক আয়াতে কেবলা মুখি হতে নির্দেশ দিয়েছে। এ জটিলতা নিরসনে শানে নুযুল এর শরণাপন্ন হওয়া ছাড়া আমাদের কোন গতি নাই| হযরত ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু থেকে বর্ণিত মুসলিম জাতির কিবলা যখন বাইতুল মুকাদ্দাস থেকে পরিবর্তিত হয়ে বাইতুল্লাহ বা ‘কাবা শরীফ’ নির্ধারিত হলো, তখন ইহুদিরা প্রশ্ন করল যে এই পরিবর্তনের হেতু কি? তাদের এ প্রশ্নের জবাবে আলোচ্য আয়াত নাযিল হয়। আয়াতের মর্ম হচ্ছে প্রতিটি দিকের স্রষ্টা আল্লাহ। তিনি সর্বত্র বিরাজমান। সুতরাং যে দিকে তিনি মুখ করতে বলেন সে দিকেই মুখ করা ফরজ। এখানে যুক্তির ঘোড়া দৌড়ানোর কোনো অবকাশ নেই।
তেমনি ইরশাদ হয়েছে-
“যারা ঈমান রাখে ও নেক কাজ করে, তারা যা কিছু পানাহার করে তাতে তাদের কোনো অপরাধ নেই, যেহেতু তারা আল্লাহকে ভয় করে ও ঈমান রাখে। (সূরা মায়েদা ৯৩)
এ আয়াতের শুধু আক্ষরিক অর্থ দেখলে মনে হতে পারে যে, মুসলমানদের জন্য কোন কিছুই আহার করা হারাম নয়। যদি অন্তরে ঈমান ও খোদাভীতি থাকে এবং নেক কাজ করে, তাহলে মানুষ যা ইচ্ছা পানাহার করতে পারে।
আবার যেহেতু এই আয়াতটি এসেছে মদ হারাম ঘোষণা সম্পর্কিত আয়াত সমূহের অব্যবহিত পরেই এ জন্য কেউ বলতে পারে যে, এ আয়াতে ঈমানদার ও নেককার ব্যক্তিদের জন্য মদ পানের অনুমতি রয়েছে (নাউজুবিল্লাহ)।
এটি নিছক ধারণা বা সম্ভাবনাই নয় বরং কতিপয় সাহাবী পর্যন্ত বিভ্রাটে পড়েছেন। তারা হযরত ওমর রাযিয়াল্লাহু তায়ালা আনহু এর সামনে এই আয়াতকে প্রমাণ হিসেবে অবলম্বন করে এ অভিমত পেশ করেন যে, ব্যক্তি যদি অতীতে নেককার হয়ে থাকে এবং তার জীবনের অধিকাংশ সময় নেক কাজে অতিবাহিত হয়ে থাকে তাহলে তার জন্য দন্ড নেই। তখন হযরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রাদিয়াল্লাহু তা’আলা আনহু উক্ত আয়াতের শানে নুযুল উল্লেখ করেই তাদের ভ্রান্তি নিরসন করেন। (কুরতুবী- খ ৬২৯৬)
বস্তুত আয়াতের প্রেক্ষাপট এই যে, যখন মদ ও জুয়া হারাম হওয়ার ঘোষণা নাযিল হল তখন কতিপয় সাহাবী প্রশ্ন করেন যে হারাম হওয়ার বিধান নাযিল এর পূর্বে যেসব সাহাবী ইন্তেকাল করেছেন এবং জীবনে মদ ও জুয়া কর্মে জড়িত ছিলেন তাদের পরিণাম কি হবে? তাদের জবাবে এ আয়াত নাযিল হয়। বলা হয় হারাম হওয়ার বিধান নাযিল এর পূর্বে যেসব মুমিন মদ পান করেছে বা জুয়ার অর্থ ভোগ করেছে তাদের কোন শাস্তি হবে না। তবে শর্ত থাকে যে তারা ঈমানদার হবেন এবং আল্লাহ তায়ালার অন্যান্য আদেশ পালনকারী হবেন।
এখানে আরো একটি উদাহরণ উল্লেখ করা গেলঃ
“নিঃসন্দেহে সাফা-মারওয়া আল্লাহর নিদর্শনাবলীর অন্তর্গত। সুতরাং যে কেউ বায়তুল্লাহর হজ করবে কিংবা ওমরা করবে, এ দুটি প্রদক্ষিন করাতে তার কোনো অপরাধ নেই।” (সূরা বাকারা-১৫৮)
এ আয়াতে ‘তার কোনো অপরাধ নেই’ এই শব্দসমূহ থেকে দৃশ্যতঃ মনে হবে যে, হজ্জ বা ওমরার সময় সাফা মারওয়া প্রদক্ষিণ করা নিছক বৈধ। ফরজ বা ওয়াজিব নয়।
হযরত উরওয়া ইবনে জোবায়ের রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু এ ধারণাই পোষণ করতেন। হযরত আয়েশা (রা.) তাকে জানিয়ে দেন যে, বস্তুত ইসলাম পূর্ব যুগে এ দুটি পাহাড়ে মূর্তি রাখা ছিল। একটি মূর্তির নাম আসিফ অন্যটির নাম নায়লা। সেজন্য সাহাবায়ে কেরামের মনে সন্দেহ হয়েছিল যে, হয়তো উক্ত মূর্তি দুটির কারণে এখন প্রদক্ষিণ করা অবৈধ হয়ে যাবে তাদের প্রশ্নের সমাধানে এই আয়াত নাযিল হয়। (মানাহিল ১খ. ১০৪)
নমুনা হিসেবে এ কয়েকটি উদাহরণ পেশ করা হল। এমন আরও অনেক দৃষ্টান্ত দেয়া সম্ভব, যা থেকে সুস্পষ্ট হয় যে, প্রচুর সংখ্যক আয়াতের মর্মার্থ শানে নুযুল জানা ব্যতীত বোধগম্য হতে পারে না।
(৩) কোরআন মাজিদে অনেক সময় এমন শব্দসমূহ ব্যবহার করা হয়েছে যা শানে নুযুল এর সাথে গভীরভাবে সম্পর্কিত। যদি প্রেক্ষাপট জানা না থাকে তাহলে সে সব শব্দ অহেতুক (নাউযুবিল্লাহ) এবং অনেক সময় সম্পর্কহীন বলে মনে হয়। এ থেকে কুরআন মাজীদের সাবলীলতা ও উচ্চমান প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। যেমন, সূরা তালাক এরশাদ হয়েছে-
“তোমাদের যেসব মহিলা হায়েস থেকে নিরাশ হয়ে গেছে, (যদি তাদের ব্যাপারে) তোমাদের সন্দেহ হয় তাহলে তাদের ইদ্দত হবে ৩ মাস এবং যেসব মেয়ের এখনো হায়েজ আসেনি তাদেরও (একই হুকুম)।” (সূরা তালাক-৪)
আয়াতে “যদি তোমাদের সন্দেহ হয়” এ শব্দসমূহের দৃশ্যত কোন তাৎপর্য আছে বলে মনে হয় না। এমনকি স্থুলদর্শী অনেকেই এ শব্দসমূহের ভিত্তিতে অভিমত প্রকাশ করেছে যে, বয়োবৃদ্ধা যে মহিলার হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে তার গর্ভ সম্পর্কে কোনো সন্দেহ না থাকলে তাকে ইদ্দত পালন করতে হবে না।
কিন্তু শানে নুযূল থেকে এখানে এ শব্দসমূহ ব্যবহারের তাৎপর্য অনুমিত হয়। হযরত উবাই ইবনে কাব রাযিআল্লাহু তা’আলা আনহু বলেন, যখন মহিলাদের ইদ্দত বর্ণনা করা হলো তখন আমি মহানবী সাল্লাল্লাহু আলাই সাল্লাম কে প্রশ্ন করলাম হে আল্লাহর রাসূল কিছু সংখ্যক নারী এমন রয়েছে যে, কোরআন মাজিদে তাদের কথা উল্লেখ করা হয়নি প্রথমত ছোট বালিকারা যাদের এখনও হায়েয হয়নি দ্বিতীয়তঃ বৃদ্ধা মহিলা যাদের হায়েয বন্ধ হয়ে গেছে । তৃতীয়তঃ গর্ভবতী মহিলারা। তখন এই আয়াত নাযিল হয়। এতে এ তিন শ্রেণীর মহিলার ইদ্দত বর্ণনা করা হয়।
(৪) কুরআন মাজীদে এমন স্থান কম নেই, যেখানে বিশেষ কোন ঘটনার দিকে সংক্ষিপ্ত ইংগিত করা হয়েছে। যতক্ষন পর্যন্ত উক্ত ঘটনা জানা না যাবে,  ততক্ষণ সেই আয়াতসমূহের মর্মার্থ কছিুতেই বুঝা যাবেনা। যেমন-
“আর যখন আপনি (ধূলির মুঠো) নিক্ষেপ করলেন, তখন আপনি তা নিক্ষেপ করেননি বরং আল্লাহ নিক্ষেপ করেছেন।” [সূরা  আনফাল ঃ ১৭]
এখানে বদর যুদ্ধের প্রতি ইংগিত করা হয়েছে। উক্ত যুদ্ধে কাফেরদের হামলার সময় মহানবী (সা.) তাদের প্রতি এক মুঠো মাটি নিক্ষেপ করেছিলেন।  এত কাফেররা ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়।
যদি শানে নুযূল জানা না থাকে, তাহলে আয়াতের মর্মার্থ  কিছুতেই বুঝে আসেনা।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url