বাংলায় ইসলাম প্রচার ও মুসলিম সমাজ গঠনে অগ্রজ “শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিযী”

শায়খ জালালুদ্দীন তাবরিযী

বাংলার প্রাথমিক সাধকদের মধ্যে এক বিশেষ সম্মান ও উচ্চ স্থানের অধিকারী হয়ে আছেন শায়খ জালাল উদ্দিন তাবরিযী।
তারই বিস্ময়কর আধ্যাত্মিক শক্তি এবং প্রচার তৎপরতার জন্য উত্তর বাংলায় ইসলাম প্রচার ও মুসলিম সমাজ গঠন ব্যাপক ও সুষ্ঠুভাবে পরিচালিত এবং সুসম্পন্ন হয়।
ধর্মপ্রাণতা, আদর্শ চরিত্র এবং অক্লান্ত মানবসেবায় মানব সেবার জন্য শাহ জালাল উদ্দিন তাবরিযী লক্ষ লক্ষ বাঙালির মনে চিরস্মরণীয় এবং বিশেষ শ্রদ্ধা ও প্রীতির পাত্র হয়ে আছেন।
শায়খ জালাল উদ্দিন বিখ্যাত সুফি খাজা শিহাব উদ্দিন সোহরাওয়াদীর নির্দেশে ও পরিচালনায় কামালিয়াত (আধ্যাত্মিক পূর্ণতা) হাসিল করেন। বাগদাদে খাজা মইনুদ্দিন চিশতির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ হয়।
মুহাম্মদ ঘুরীর দিল্লি ও আজমির বিজয়ের সময় অর্থাৎ ১১৯২ সালে শায়খ জালাল উদ্দিন এ উপমহাদেশে আসেন।

তিনি ব্যাপকভাবে আরব ইরাক ও ইরান ভ্রমণ করেন। নিশাপুর এর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সূফী-সাধক শায়খ ফরিদ উদ্দিন আত্তার এর (১১১৮-১২২৯ খ্রি.) তার দেখা হয়। এদেশে প্রথমে তিনি মুলতানে পদার্পণ করেন।
মুলতানে তিনি তার ঘনিষ্ট সহমর্মী বাহাউদ্দিন যাকারিয়া (১১৬৯-১২২৯খ্রী.) এবং খাজা কুতুবুদ্দীন বখতিয়ার উমীর (মৃত্যু ১২৩৫) সঙ্গে কিছুদিন অতিবাহিত করেন।
মুলতান থেকে দিল্লি আসেন । দিল্লীর সুলতান শামসুদ্দীন ইলতুতমিশ তাঁকে বিশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করে ধন্য হন। বদায়ুনে তিনি এক কুখ্যাত হিন্দু ডাকাতকে ইসলামের দীক্ষা দেন। পরবর্তীকালে এ ডাকাত খাজা আলী নামে খ্যাত হন।

১২১৩ সালে শায়খ জালালুদ্দিন লক্ষণাবতী পৌঁছেন এবং পান্ডুয়ায় এক হিন্দু মন্দির এর নিকট তার আস্তানা এবং খানকা স্থাপন করেন। সর্বপ্রকার প্রার্থিব আসক্তি থেকে তিনি মুক্ত ছিলেন। তিনি তার সমগ্র জীবন আল্লাহ মানুষের খেদমতে কোরবান করেন। তিনি বলেন, নারী ও ধন-সম্পদে যার আশক্তি আছে, তার পক্ষে মঙ্গল লাভ অসম্ভব। গুরু শায়খ শাহাবুদ্দিন সোহরাওয়ার্দী প্রতি অবিচল ভক্তি ও বিস্ময়কর সেবা পরায়ণতা তাঁর আধ্যাত্মিক নিষ্ঠার একটি মহান উদাহরণ। তার সেবা ও আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে গুরু একদিন বলেছিলেন- শায়খ জালাল আমার সবকিছু নিয়ে গেছে অর্থাৎ তিনি গুরুর সমস্ত আধ্যাত্মিক শক্তির পূর্ণ উত্তরাধিকারী হয়েছেন।
ধ্যানে ও প্রার্থনায় তিনি গভীরভাবে মগ্ন ও তন্ময় এবং আল্লাহর প্রেমে বুদ ও মস্ত হয়ে থাকতেন। সর্বানুভূতী ও আধ্যাত্মিক চেতনায় তিনি একান্তে আল্লাহর নূর প্রত্যক্ষ করেছেন ।

সালাতে তিনি দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করতেন এবং নফসে আম্মারা (পশু আমি)পেছনে ফেলে নফসে লাওয়ামা (যুক্তিবাদী আমি)অতিক্রম করে নফসে মুতমাইন্না (নিস্তরঙ্গ, পরিতৃপ্ত ও পরিশান্ত আমি) উপস্থিত হয় তিনি পরম প্রিয়তমের প্রেম হয় প্রসন্নতা লাভ করে সর্বোচ্চ আধ্যাত্মিক দরজায় উপনীত হন।
বিরাট আধ্যাত্মিক ব্যক্তিত্ব এবং মানব সেবার দ্বারা শায়খ জালাল উদ্দিন বাংলাদেশ অলৌকিক কার্য সাধন করেন। অবহেলিত-নির্যাতিত হিন্দু, বৌদ্ধগণ ত্রাণ লাভের জন্য দলে দলে তার আশ্রয়ে ইসলাম গ্রহণ করেন।
এভাবে তিনি উত্তর বাংলায় এক শক্তিশালী মুসলিম সমাজের ভিত্তিভূমি রচনা করেন।

তার খানকা আধ্যাত্মিক, মানসিক ও মানবিক অনুশীলনের কেন্দ্র হয়ে পড়ে। তার লঙ্গরখানায় অভুক্ত, দরিদ্র জনসেবা ও শান্তি লাভ করে ।এভাবে আধ্যাত্মিক ও মানসিক সেবার দ্বারা শায়খ জালাল উদ্দিন উত্তর বাংলার হিন্দু ও মুসলিম সমাজে এক নতুন নৈতিক ও তামাদ্দুনিক জীবন গড়ে তোলেন ।
হিন্দুদের অশেষ ভক্তি ও শ্রদ্ধা তিনি লাভ করেছিলেন। ফলে কালক্রমে সত্য পীরের ধর্ম ও পূজা হিন্দু সমাজে প্রবর্তিত হয়। এভাবে রক্ষণশীল হিন্দু সমাজ উদার ও প্রগতিশীল হয়ে উঠে।
দেওয়ায় (পান্ডুয়া, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের মালদা শহরের ১২ মাইল উত্তরে এবং আরেক প্রাচীন নগর গৌড় হতে ২০ মাইল দূরে অবস্থিত) সাধক-শ্রেষ্ঠ শায়খ জালাল উদ্দিন তাবরিযীর সমাধি বিদ্যমান। তাঁর মৃত্যুর বহু পরে ১৩৪২ সালে আলাউদ্দিন আলী শাহ্ কর্তৃক এ সমাধি সৌধটি নির্মিত হয়।
উৎস-আমাদের সূফী সাধক, আ.ন.ম বজলুর রশীদ
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url