“মহাকবি শেখ সাদী” স্বার্থক জীবনের প্রতিচ্ছবি..


মহাকবি শেখ সাদী

আসল নাম শরফুদ্দীন। ডাকা হত মুসলেহউদ্দীন নামে। আর উপাধি হচ্ছে সাদী। সাদী তাঁর প্রকৃত নাম নয়, তিনি বিশ্বের মানুষের কাছে পরিচিতি পেয়েছেন তার উপধি ‘সাদী’ নিয়ে। অর্থাৎ শেখ সাদী নামে। জানা যায় কবির বাবা তৎকালীন শিরাজের বাদশাহ আতাবক সাদ বেন জঙ্গীর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন। কবি নিজে তুকলাবীন সাদ জঙ্গীর রাজত্বকালে কবিতা লিখতেন, এ কারণেই তিনি তার নামের সাথে সাদী উপাধি যোগ করলেন এবং পরবর্তীসময়ে শেখ সাদী নামেই পরিচিত হন।

শেখ সাদীর জন্ম

শেখ সাদীর জন্মসালের ব্যাপারে অনেক মতামত আছে। তবুও সাধারণ ভাবে বলা যায় তিনি ৫৮০ হিজরী মোতাবেক ১১৮৪ খৃস্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন। মৃত্যুসন সবার মতে ৬৯১ হিজরী মোতাবেক ১২৯২ খৃস্টাব্দ।

শেখ সাদী শৈশব ও বাল্যকাল

পরহেযগার বাবার সাহচর্যেই শেখ সাদী শৈশব পার করেন। পিতার দেখাদেখি সাদীও সালাত, সাওম ও রাত্রিকালীন ইবাদতের অভ্যাস গড়ে উঠে। পিতার উৎসাহে কুরআন অধ্যয়নে তিনি অনেক সময় ব্যয় করেন। পিতার আদর্শেই আদর্শবান হয়ে গড়ে ওঠেন শেখ সাদী।
কৈশোরে সাদীর পিতা মৃত্যুবরণ করেন। পিতার মৃত্যুর পর সাদী পুণ্যবতী ও গুণবতী মায়ের তত্ত্বাবধানে বেড়ে উঠতে থাকেন। এ সময়ে তিনি একজন পন্ডিত ব্যক্তির স্নেহধন্য হন। তিনি হলেন তাঁরই শ্রদ্ধাভাজন মামা আল্লামা কুতুবুদ্দীন শিরাজী। যিনি কিনা হালাকু খাঁর অন্যতম দরবারী বন্ধু ছিলেন।
তাঁর বাল্যকাল সম্বন্ধে ঐতিহাসিক সূত্রে তেমন কিছু পাওয়া যায় না। তবে তাঁর নিজের লেখা হতে চমকপ্রদ কিছু ঘটনা পাওয়া যায়। যেমন-তিনি যখন নিতান্ত ছোট তখন তাঁর আব্বা লেখার জন্য তাঁকে একটি ‘তখতি’ ও হাতের আঙ্গুলে পরার জন্য একটি সোনার আঙটি কিনে দেন্। কিন্তু এক মিষ্টি বিক্রেতা কবিকে মিষ্টি দিয়ে ভুলিয়ে আংটি নিয়ে চম্পট দেয়। আংটি খোয়া গেলেও একথা বুঝতে কষ্ট হয় না যে কবি মিষ্টি খুব পছন্দ করতেন।
একবার ঈদের দিন ঈদের ভিড়ে শেখ সাদী বাবার সাথে জামার কাপড় ধরে চলছিলে। যেন পিতার কাছে থেকে তিনি আলাদা না হয়ে যান। কিন্তু পথে খেলাধুলায় লিপ্ত বালকদের দেখে জামার প্রান্ত ছেড়ে তিনি তাদের দলে ভিড়ে যান। এরপর যখন শেখ সাদীর বাবা তাঁকে ফিরে পান তখন রেগে বলেন, “গাধা! তোকে না বলেছিলাম কাপড় না ছাড়তে।”
জানা যায়, একবার তিনি তাঁর আব্বার সাথে সারারাত ইবাদতে কাটিয়ে দিলেন। এ সময় ঘরের অন্যজনেরা ঘুমে অচেতন। এ অবস্থা দেখে সাদী তাঁর বাবাকে বললেন, ‘দেখছেন, এসব লোক কেমন অচেতন হয়ে ঘুমাচ্ছে। কারো এতটুকু সৌভাগ্য হচ্ছেনা যে, উঠে দু’রাকাত সালাত পড়ে।’ এ কথার উত্তরে সাদীর বাবা বললেন, ‘তুমি যদি শুয়ে থাকতে তাহলেই ভাল হতো; তাহলে পরনিন্দা হতে বিরত থাকতে পারতে।’

শেখ সাদীর প্রাথমিক শিক্ষা

শেখ সাদীর প্রাথমিক শিক্ষা তাঁর মহান বাবার নিকট হয়েছিল। কচি বয়সেই তিনি পিতৃহীন হন। এ সময়ে তিনি শিরাজের খ্যাতিমান আলেম-উলামাদের সহচর্যে আসেন এবং জ্ঞান আহরণ করতেন।
প্রথম দিকে তিনি শিরাজের সুলতান গছদদৌলা প্রতিষ্ঠিত গছদিয়া মাদরাসায় ভর্তি হন। পরে তিনি আরো কয়েকটি মাদরাসায় শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ সময়ে দেশের শাসক আতাবক জঙ্গী দেশ জয়ে ব্যস্ত থাকার ফলে দেশ গঠনে ছিলেন একেবারেই উদাসীন । ফলে দেশের অস্থিতিশীল পরিবেশে সেখানে শিক্ষার কোন ভাল অবস্থা ছিল না বললেই চলে।

শেখ সাদীর উচ্চ শিক্ষা

শেখ সাদী উচ্চ শিক্ষা গ্রহণের জন্য বাগদাদ যান এবং সেখানকার বিখ্যাত মাদরাসা নিযামিয়ায় ভর্তি হন। এ মাদ্রাসার শুরু হতে মাদরাসা প্রধান ছিলেন শিরাজের সুখ্যাত আলেম শেখ আবু ইসহাক শিরাজী। শেখ সাদী অল্পকালের মধ্যে তাঁর প্রতিভার স্বাক্ষর রাখেন এবং বৃত্তি লাভ করেন।
মাদরাসা নিযামিয়ায় শিক্ষাকালীন তিনি হাদীস শাস্ত্র অধ্যয়নের জন্য সে সময়ের বিশ্ববিখ্যাত শায়খ আল্লামা আবুল ফরজ আবদুর রহমান ইবনে জৌজীর নিকট শিক্ষা গ্রহণ করেন। এ আলেম ছিলেন তাফসীর ও হাদীসশাস্ত্রে তখনকার ইমাম। ইবনে জৌজীর আরবী ভাষায় অনেক গ্রন্থের রচয়িতা ছিলেন। শেখ সাদী আল্লামা শাহবুদ্দীন সুহরাবদীর সাহচর্য লাভ করেছিলেন।

শেখ সাদীর জীবনের অলিগলি

শিশুকাল থেকে যদিও শেখ সাদী সাধারণ ও দরবেশী জীবন বেশি পছন্দ করতেন তবুও তিনি জ্ঞান অর্জনকে অনেক বেশি গুরুত্ব দিয়েছিলেন। এ ব্যপারে তিনি নিজে বলেছেন, ‘দরবেশ শুধু নিজকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায়ই থাকে। অপরপক্ষে আলেমদের প্রচেষ্টা থাকে নিজের সাথে অন্য ডুবন্ত লোকদের বাঁচনোর।’
শেখ সাদী বাগদাদের পড়াশোনা শেষ করে দেশভ্রমণে বের হন।
তিনি এশিয়া ও আফ্রিকার দেশগুলো দীর্ঘ সময় ধরে ভ্রমণ করেন। তিনি তাঁর দীর্ঘ জীবনকে এরকম ভাগ করে নিয়েছিলেন-
ত্রিশ বছর লেখাপড়ায়…..
ত্রিশ বছর দেশভ্রমণে…
ত্রিশ বছর গ্রন্থ রচনায়…
ত্রিশ বছর আধ্যাত্মিক চিন্তায়…..
জনশ্রুতি আছে, তাঁর জীবনের উক্ত চারটি পর্যায় যেদিন পূর্ণ হয় সেদিনই নাকি তিনি পরলোক গমন করেন।
শেখ সাদী দেশ ভ্রমণ করতে গিয়ে এমন পান্ডিত্য অর্জন করেন যে তিনি আঠারটি ভাষা আয়ত্ত করেন। এর ভেতর অনেক ভাষা তার মাতৃভাষার মতই ছিল। আর তিনি এত অধিক দেশ ভ্রমণ করেন যে ইবনে বতুতা ছাড়া প্রাচ্যের পর্যটকদের মধ্যে কেউই এত বেশি দেশ ভ্রমণ করেন নি।
আশ্চর্যের বিষয় হল, তিনি পায়ে হেঁটে চৌদ্দবার হজ্জ্ব পালন করেছিলেন।
তিনি তার ভ্রমণকালে অসংখ্য নদী এমনকি পারস্যোপসাগর, ভারত মহাসাগর, আরব সাগর প্রভৃতি পাড়ি দিয়েছেন। আহরণ করেছেন জ্ঞানের রাজ্যে অগণিত মনি মুক্তা, হিরা-জহরত।
দেশ সফরকালে শেখ সাদী এক সময়ে কোন কারণে দামেস্কবাসীর প্রতি বিরাগভাজন হয়ে ফিলিস্তিনের জঙ্গলে আশ্রয় নেন। এ সময়ে তিনি দুর্ভাগ্যক্রমে তখনকার খৃস্টানদের হাতে বন্দী হন। খৃস্টানগণ বুলগেরিয়া ও হাঙ্গেরী হতে নিয়েআসা ইহুদী বন্দীদের সাথে কবিকে খাদ খননের কাজে নিয়োজিত করে। একদিন সৌভাগ্যক্রতে তাঁর পিতার এক বন্ধু তাঁকে এ অবস্থায় দেখতে পান। তিনি দশ দিরহাম মুক্তিপণ দিয়ে তাঁকে বন্দীদশা হতে মুক্ত করেন এবং একশত আশরাফী দেনমোহর ধার্য করে নিজ কন্যার সাথে বিবাহ দেন। কিন্তু সাদীর এ স্ত্রী খুব বাচাল ছিলেন বলে এই বিয়ে বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। তিনি একদিন সাদীকে লক্ষ্য করে বলেছিলেন, ‘তুমি কি আগের জীবনের কথা ভুলে গেছ ? তুমিতো সেই ব্যক্তি যাকে আমার বাবা দশটি রূপার দিনার দিয়ে মুক্ত করেছেন।’ উত্তরে কবি বলেছিলেন, ‘হ্যাঁ, তিনি দশ দিনারে মুক্ত করে একশত আশরাফী দিয়ে পুনরায় আমাকে বন্দী করেছেন।’
ভারত সফরকালের একটি ঘটনা তাঁর বুসতাঁ কাব্যবইয়ে উপস্থাপন করেছেন।
ঘটনাটি হল সোমনাথ মন্দিরের। কবির মুখেই শুনি সেই ঘটনা-
“আমি যখন সোমনাথ এসে দেখতে পেলাম হাজার হাজার লোক এসে মূর্তির নিকট নিজ নিজ মনের বাসনা হাসিলের জন্য পূজা দিচ্ছে তখন আমি অবাক হলাম। হাজার হাজার জীবিত লোক এক প্রাণহীন মূর্তির নিকট মনবাসনা পুরণের প্রার্থনা জানাচ্ছে।”
একদিন আমি এক ব্রাহ্মণের নিকট গিয়ে এর রহস্য জানতে চাইলাম। ব্রাহ্মণ আমার কথা শুনে মন্দিরের পূজারীদের ডাকলো-তারা এসে ক্রোধান্বিত হয়ে আমাকে চতুর্দিক থেকে ঘিরে ফেললো, আমি তখন সমূহ বিপদ দেখে বললাম, তোমাদের দেবতার অপদস্ত করা আমার লক্ষ্য নয়…….তবে আমি এখানে এসেছি নতুন, এ মহান দেবতার পূজা কিভাবে দিতে হবে জানি না বলে জানতে চেয়েছি। আমাকে তা জানিয়ে দাও যেন ঠিক ভাবে পূজা করতে পারি।
তখন পূজারিগণ খুশি হয়ে আমাকে পূজার নিয়ম কানুন শিখিয়ে দিয়ে মন্দিরে নিয়ে গেল।
তারা আরও বলল, আজ রাতে তুমি মন্দিরে থাক তখন এ দেবতার শক্তি দেখতে পাবে।
আমি সারারাত মন্দিরে কাটালাম।
ভোর হওয়ার অল্প সময় পূর্বে অসংখ্য স্ত্রী-পুরুষ মন্দিরে প্রবেশ করল। তখন মূর্তি একটি হাত তুলে পূজারীদের আশীর্বাদ করল। সকলেই তখন জয় জয় করে চিৎকার করে উঠল। এরপর শান্তমনে সকলে চলে গেল। ঐ ব্রাহ্মণ আমাকে সহাস্যে বলল, কি বল, এখন বিশ্বাস হল তো!
আমি বাহ্যিকভাবে কেঁদে কেঁদে নিজের অজ্ঞতার জন্য দুঃখ প্রকাশ করলাম। তখন ব্রাহ্মণগণ আমার প্রতি সদয় হয়ে মূর্তির নিকট নিয়ে গেলে আমি তার হাত চুম্বন করে সম্মান জানালাম। এরপর যেন সত্যিকার ব্রাহ্মণ হয়ে আমি বিনা বাধায় মন্দিরে আসা যাওয়া করতে লাগলাম।
আর এক রাতে সবাই চলে গেলে, আমি মন্দিরের দরজা বন্ধ করে মূর্তির নিকট গিয়ে এর ভেদ জানতে চাইলাম। আমি দেখলাম মূর্তির পিছনে একটি পর্দার আড়ালে রশি ধরে একজন পূজারী বসে আছে। রশির একদিক মূর্তির সাথে বাঁধা। সে পূজারী যখন রশি ধরে টানে তখনই মূর্তির হাত উপরে উঠে যায় আর সাধারণ লোক এটাকেই মূর্তির শক্তি বলে উৎফুল্লে নাচতে থাকে।
সে পূজারী পর্দার আড়াল হতে যখন দেখতে পেল আমি তাদের গোপন রহস্য জেনে ফেলেছি তখন সে দৌড়ে পালিয়ে যেতে চাইল। আমি তখন প্রাণের ভয়ে তাকে ধরে এক কূপে ফেলে দিলাম।
এরপর সে রাতেই সোমনাথ ছাড়লাম। ভারতের সুদীর্ঘ পথ অতিক্রম করে হেযাজে এসে পৌছলাম।”
শেখ সাদী হলেন বিশ্ববিখ্যাত কয়েকজন কবির মধ্যে অন্যতম। তাঁর রচিত গুঁলিস্তা ও বুঁসতা বিশ্ব সাহিত্যের অমূল্য সম্পদ। অনেকে মনে করেন, এই গ্রন্থ দুটি অধ্যয়ন ব্যতীত ফারসী সাহিত্য অধ্যয়ন অপূর্ণ থেকে যায়। এ গ্রন্থ দুটিকে একত্রে ‘সাদী নামাহ’ ও বলে। নৈতিকতা বিষয়ক কাব্যগ্রন্থ হল বুঁসতা। আর নৈতিকতা বিষয়ক গদ্যগ্রন্থ হল গুঁলিস্তা। গুলিস্তাঁয় লেখক খুবই সহজ সরল হৃদয়গ্রাহী ভাষায় নৈতিকতার বিভিন্ন বিষয় গল্প আকারে পরিবেশন করেছেন। এর ভেতর অবশ্য কবিতাও আছে। এমন কি কুরআন হাদীসের উদ্ধৃতিও লেখক প্রয়োগ করেছেন নিজের বক্তব্যকে সুন্দর ও শক্তিমান করার জন্য।

শেখ সাদীর কাব্য ও সাহিত্য প্রতিভা

সাদী ছিলেন অসাধারণ কাব্য প্রতিভার অধিকারী। এ ব্যাপারে মাও. আবদুর রহমান জামী বলেছেন, ‘রুমীর মসনবী, আনোয়ারীর কাসিদা এবং সাদীর গযল সমপর্যায়ের।’
শেখ সাদীর কাব্য প্রতিভা নিয়ে সুন্দর একটা গল্প কাথিত আছে। গল্পটি হল-‘শিরাজের এক ব্যক্তি শেখ সাদীর কাব্য প্রতিভা সম্পর্কে সন্দেহ পোষন করতেন। এক রাতে ঐ ব্যক্তি স্বপ্নে দেখলেন, একজন ফেরেশতা একখানি নূরের থালা নিয়ে মাটিতে অবতরণ করল। ঐ ব্যক্তি জানতে চাইল কি ব্যাপার? ফেরেশতা জবাবে বললেন, শেখ সাদীর একটি কবিতা আল্লাহর দরবারে মকবুল হয়েছে-সে কারনে বেহেশতের এ উপহার। কবিতাটি হল-
জ্ঞানিদের চোখে
গাছের ঐ সবুজ পাতা
খোদা তত্ত্বের
এক একখানি গ্রন্থ।
যখন ঐ ব্যক্তির ঘুম ভাংল তখন সেই রাতের সাদীর গযলটির ব্যাপারে স্বপ্নে দেখা খোশ খবর জানতে গেলেন। গিয়ে আশ্চর্য হলেন! লোকটি দেখেন উজ্জ্বল একটি বাতি জ্বেলে শেখ সাদী সেই কবিতাটিই পড়ছেন।’
আরো একটি ঘটনা, সাদী তখন দেশ বিদেশে বেশ প্রসিদ্ধ হয়ে পড়েছেন। একদিন শিরাজ হতে ষোল-শ মাইল দূরের কাশগড়ে বেড়াতে গেলেন। সেখানে গিয়ে তিনি দেখলেন ছোট বড় সবাই তাঁর নাম জানে ও তাঁর কাব্য প্রতিভায় মুগ্ধ।
সাদী উঠেছিলেন কাশগড়ের জামে মসজিদে। সেখানে একজন ছাত্র আল্লামা যমখশীর একটি গ্রন্থ হাতে নিয়ে বলেছিল, ‘কোরবে যায়েদ মির’।
ছাত্রটির কথা শুনে শেখ সাদী বললেন, ‘খাওয়ারযমের ও তাঁর শত্রুর মাঝে সন্ধি হয়ে গেছে তবে যায়েদ ও মীরের ঝগড়া এখনো চলছে।’ ছাত্রটি একথা শুনে সাদীকে বললো, জনাবের দেশ কোথায়?
‘শিরাজ’।
তবে তো সাদীকে চিনেন। তাঁর দু/একটি পংক্তি শুনাবেন কি?
আরবীতে কিছু পংক্তি বললেন সাদী।
যদি দু’একটি ফারসী পংক্তি শুনাতেন। বলল ছাত্রটি ।
একটি ফরাসী বলল পেশ করলেন সাদী।
পরে যখন ছাত্রটি জানলো ‘ইনিই হলেন মহাকবি শেখ সাদী। তখন সে কাতর হয়ে কবির কাছে ক্ষমা চেয়ে বলল, কাশগড়ে যদি কিছুকাল অবস্থান করতেন তবে আপ্যায়ন করতে পারতাম।’
কিন্তু শেখ সাদী কাশগড়ে আর থাকতে পারেন নি। তিনি সেখান থেকে তিবরীজ চলে যান।
শেখ সাদী তাঁর “গুলিস্তা” গ্রন্থ অন্যন্য এক উপায়ে উপস্থাপন করেছেন-
যেটি মূলত গদ্য গ্রন্থ হলেও এখানে একই সাথে পদ্যেরও সমাবেশ ঘটিয়েছেন। একটি ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি ঘটনার পাশাপাশি প্রবাদ বাক্য ও কাব্যের মিশ্রণে ঘটনার ভাব যথার্থতাকে শক্তিমান করে ফুটিয়ে তুলেছেন।
গুলিস্তার এমনই একটি ছোট ঘটনা এখানে উল্লেখ করছি-
তুরস্কের বাদশাহ আগলামাশের প্রসাদে এক সৈনিক পুত্রকে দেখলাম তাঁর জ্ঞান, প্রতিভা, বুদ্ধি ও বিচক্ষণতা বর্ণনাতীত। বাল্যকাল থেকে তাঁর চেহারায় মহত্বের সমূহ লক্ষণ স্পষ্ট ছিল। বিচক্ষণতার আলোকচ্ছটা তার চাল চলনে ছিল প্রষ্ফুটিত।
পংক্তি :
ললাটে তার স্পষ্ট ছাপ বুদ্ধিমত্তার
সৌভাগ্য তারকার জ্বলছে আলো খুবই চমৎকার
বাদশাহ তাকে রাজকীয় পদে নিযুক্ত করলেন। কেননা তার মধ্যে বাহ্যিক ও অভ্যন্তরীণ উভয় সৌন্দর্যের সমাবেশ ছিল।
জ্ঞানীগণ বলেন-
“ধনাট্যতার সম্পর্ক হৃদয়ের সাথে সম্পদের সাথে নয়।
উৎকর্ষতার সম্পর্ক জ্ঞানের সাথে বয়সের সাথে নয়।”
তার সঙ্গীদের মধ্যে কেউ কেউ তার পদোন্নতির কারণে শত্রুতা করতে লাগলো। তার বিরুদ্ধে খেয়ানতের মিথ্যা অভিযোগ আরোপ করল এবং তাকে হত্যা করার ব্যর্থ চেষ্টা করতে লাগলো।
পংক্তি
বন্ধু যদি হয় করুণাময় –
শত্রুতে তার কি হবে লয়?
বাদশা বা লোকটিকে জিজ্ঞেস করলেন- তোমার বিরুদ্ধে এদের শত্রুতার কারণ কি?
সে বলল- জাহাপনার অনুগ্রহের ছায়ায় থেকে সবাইকে সন্তুষ্ট করতে পেরেছি। কিন্তু হিংসুকদের সন্তুষ্ট করতে পারিনি। তরা কেবল আমার প্রাপ্ত নেয়ামত ধ্বংশ হলেই সন্তুষ্ট হবে।
জাহাপনার সম্রাজ্য বিরস্থায়ী হোক।
পংক্তি
আমিতো সক্ষম যে, কারো অন্তরে কষ্টই না দিতে
তবে হিংসুকদের কি করব আমি? তারা নিজেরাই চায় দুঃখ-কষ্ট পেতে
ওহে হিংসুক, তুমি বিনাস হও। কেননা হিংসা এমই যাতনা
যার কষ্ট থেকে মৃত্যু ছাড়া মুক্তি মিলেনা।
দুর্ভাগারা নিতান্তিই চায়-
সৌভাগ্যবানদের সম্পদ-সম্ভ্রম বিনাশ হওয়ায়
দিবালোকে যদি চামচিকা চোখে না দেখে
তাতে সূর্যালোকের কি দোষ বল আছে?
যদি তুমি সত্য শুনতে চাও (তাহলে বলছি) –
হাজারো অন্ধ ভাল সূর্যের আলোহীনতা থেকে, একথা জেনে নাও।
অনেক ইংরেজ লেখক শেখ সাদীকে প্রাচ্যের শেক্সপীয়র বলে অবহিত করেছেন।
শেখ সাদীর বিখ্যাত গ্রন্থগুলি হল-
১. করিমা ২. গযলিয়াত ৩. গুলিসতাঁ ৪. সাহাবিয়া ৫. কাসায়েদে ফারসী ৬. কাসায়েদে আরাবীয়া ৭.বুস্তুাঁ ৮. কুল্লিয়াত ইত্যাদি।
বুস্তাঁ ও গুলিসতাঁ গ্রন্থ দুটি এশিয়ায় সব থেকে জনপ্রিয়তা পেয়েছে। এই গ্রন্থ দুটির অনেক কথায় পারশ্য সাহিত্যে প্রবাদে পরিণত হয়েছে।
পন্ডিতদের মতে গদ্য ও পদ্য মিলিয়ে ফারসি ভাষায় ৪ খানি গ্রন্থ শ্রেষ্ঠ। তা হল-
মহাকবি ফেরদাউসী’র ——- শাহনামা
জালালুদ্দীন রুমি’র ——- মসনবী
শামসুদ্দীন হাফেযে’র ——- দিওয়ান
এবং শেখ সাদীর ————- গুলিস্তাঁ
গুলিসতাঁ উপদেশমূলক অনন্য সুন্দর সব গল্পে ভরপুর। যেমন-‘এক বাদশাহ এক অপরাধীকে মৃত্যুদন্ড দেন। লোকটি বহু মিনতি করেও যখন ক্ষমা পেলেন না তখন বাদশাহকে গালি দিয়ে বসল। বাদশাহ তার কথা বুঝতে না পেরে উজিরের নিকট জানতে চাইলেন সে কি বলেছে।
সেই উজির ছিলেন ভাল মানসিকতার, তাই তিনি লোকটির উপকারার্থে বললেনঃ হুযুর লোকটি বলছে-যিনি রাগ হজম করে অপরাধ করেন, তিনি খোদার বন্ধু। একথা শুনে বাদশাহ অত্যন্ত খুশি হয়ে লোকটিকে ছেড়ে দেয়ার নির্দেশ দিলেন। অন্য একজন হিংসুক উজির ছিলেন। তিনি বাধা দিয়ে বললেন, হুযুর এ মিথ্যা কথা। লোকটি আপনাকে মন্দ বলেছে।
তা শুনে বাদশাহ বললেন, তোমার কথা সত্য হলেও অন্য উজিরের মিথ্যার চেয়েও খারাপ। কারণ তাতে ছিল অন্যের উপকারের উদ্দেশ্য-আর তোমার কথায় অন্যের অনিষ্ঠের ইচ্ছা।’ বাদশাহ লোকটিকে ক্ষমাই করেছিলেন।
এমনি সব গল্প দিয়ে সাজানো হয়েছে গুলিসতাঁ যার তুলনা বিশ্ব সাহিত্যে দ্বিতীয়টি নেই।
শেখ সাদী দৈহিকভাবে খুবই সুস্বাস্থ্যের অধিকারী ছিলেন। কষ্ট সইতে পারা এ মানবটি প্রচন্ড উদারও ছিলেন। তিনি পায়ে হেঁটে দেশের পর দেশ ভ্রমণ করেছেন। এমনকি তিনি ফকির দরবেশের মত এসব পথে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই খালি পায়ে পাড়ি দিয়েছেন।
এ রকম ভ্রমণে যে নানা ধরনের দুঃখ-কষ্ট আসে তা ভুক্তভোগীরাই জানেন। সাদীর জীবনেও নানা বিপদ আপদ এসেছ এবং তিনি তা সহজভাবেই গ্রহণ করেছেন। কিন্তু একবার তিনি নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি। এ ব্যাপারে গুলিস্তাঁ গ্রন্থে তিনি লিখেছেন, ‘আমি কখনো সময়ের কঠিনতা ও আসমানের নির্মমতার ব্যাপারে অভিযোগ করিনি। তবে একবার আমি ধৈর্য্ ধরে রাখতে পারিনি। আমার পায়ে জুতা ছিলনা এবং জুতা কিনার মত অর্থও ছিল না। তখন কষ্ট ভরা মনে কুফার মসজিদে গিয়ে উঠলাম। তথায় গিয়ে দেখি একটি লোক শুয়ে আছে যার একখানি পা-ই নেই। তখন খোদাকে শোকর জানিয়ে নিজের খালি পা থাকাও গনিমত মনে করলাম।’
শেখ সাদী তাঁর দীর্ঘ জীবনে অনেক বিচিত্র ঘটনা দেখেছেন। তিনি দেখেছেন-বিভিন্ন রাজবংশের উত্থান পতন। তিনি উজিরের ছেলেকে ভিক্ষা করতে দেখেছেন। আবার ভিক্ষুককে দেখেছেন উজির স্থানে যেতে। তিনি দেখেছেন মুসলিম সাম্রাজ্যের শৌর্য্ বীর্য্, সাথে সাথে পতনের দৃশ্য। তাঁরই সম্মুখে তাতারদের হাতে সাত লক্ষ মুসলমান খুন হয়েছে। খোরাসানের চারটি শহর, বলখ, মরদ, হেরাত এবং নিশাপুর ধ্বংস হতে দেখেছেন।
শেখ সাদী বড় বড় দুর্ভিক্ষের সম্মুখীন হয়েছেন। এ সময়ে তিনি দেখেছেন ক্ষুধার তাড়নায় কিভাবে মানুষ মারা যায়। তিনি নিজেই আরবী একটি মর্সিয়ায় বলেছেন-
আব্বাসীয় খেলাফতের ধ্বংসের পর
যে সমাধান হয়েছে
খোদা তার সহায় হোক।
কেননা
যায়েদের বিপদ
উমরের চোখ খুলবে।

শেখ সাদীর পরলোক গমন

এই মহান মনীষী কবিকুল শিরোমণি শেখ সাদী ৬৯১ হিজরী মোতাবেক ১২৯২ খৃস্টাব্দে আতাবকানের বংশের রাজত্বের শেষ সময়ে শিরাজ নগরীতে ইন্তিকাল করেন। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল একশত বিশ বছর। শিরাজ নগরীর দিলকুশার এক মাইল পূর্ববর্তী পাহাড়ের কিনারে কবিকে সমাধিস্থ করা হয়।
Next Post Previous Post
No Comment
Add Comment
comment url